1. আগামী – সুকান্ত ভট্টাচার্য জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ, আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ; মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে, বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোরRead more

    আগামী – সুকান্ত ভট্টাচার্য

    জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
    আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;
    মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে
    মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।
    যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে
    তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে,
    বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা
    শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।
    আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা
    উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা;
    তার পর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে,
    ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে।
    সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়;
    শাখায় শাখায় বাঁধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়;
    অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে
    জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে।
    আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে;
    জয়ধ্বনি কিশলয়ে; সম্বর্ধনা জানাবে সকলে।
    ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি,
    বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি।
    সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে
    তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে;
    ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন
    একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।।

    কবিতা সম্মন্দে
    এই কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ছাড়পত্র”(১৯৪৮) এর অন্তর্ভুক্ত ।

     

    See less
  2. বোধন হে মহামানব, একবার এসো ফিরে শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে, এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার; লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার । এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি; কোথাও নেইকো পার মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকারRead more

    বোধন

    হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
    শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
    এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
    লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার ।
    এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
    নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
    কোথাও নেইকো পার
    মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
    আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
    এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
    ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
    হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো ।

    ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
    হে নীড়-বিহারী সঙ্গী ! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
    ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
    পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে । তবু আজো বিস্ময় আমার –
    ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
    তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ ।
    তোমার ক্ষেতের শস্য
    চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
    তাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
    লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
    তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
    অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল –
    তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল ।
    তুমি তো প্রহর গোনো,
    তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
    তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
    তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে –
    কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফের দুর্বিপাকে ।

    পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার !
    সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
    দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
    সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার :
    কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার –
    এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার ?

    লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
    অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম ।
    সুদ ও আসলে আজকে তাই
    যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই ।

    কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
    দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
    লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
    বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে ।
    লোভের মাথায় পদাঘাত হানো-
    আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো ।
    দৈত্যরাজের যত অনুচর
    মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর;
    মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-
    হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ ।

    তোমার ফসল, তোমার মাটি
    তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
    তোমার চেতনা চালিত হাতে ।
    এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে ?
    স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
    মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি ?
    এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র ?
    করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র :
    শোন্ রে মালিক, শোন্‌রে মজুতদার !
    তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-
    হিসাব কি দিবি তার ?

    প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
    ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
    সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
    কখনো ভুলতে পারি ?
    আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
    স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
    চিতা আমি তুলবই ।

    শোন্ রে মজুতদার,
    ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
    করব তোকে এবার ।

    তারপর বহুশত যুগ পরে
    ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
    নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
    মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার ।
    তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার
    মানুষ ছিল কি ? জবাব মেলে না তার ।

    আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
    দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
    আজকের নৈঃশব্দ্য হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি ।
    দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা,
    প্রার্থনা করো :
    হে জীবন, হে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
    আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
    প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
    তুষার-গলানো উত্তাপ ।
    টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
    অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী ।
    শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
    একত্রিত হোক আমাদের সংহতি ।

    তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
    বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
    তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি তো মানুষ নও-
    গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও ।
    ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
    দেয় তোমার মুখেতে অন্ন, বহুতে বল
    পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
    ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই ॥

    সারমর্ম

    এই কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ছাড়পত্র”(১৯৪৮) এর অন্তর্ভুক্ত । বামপন্থী মনোভাবাপন্ন সুকান্তের কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সাম্যবাদী চিন্তা,শোষিত-নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র সক্রোধ প্রতিবাদ।যে সময় অন্যান্য তরুণেরা সরল তরল প্রেমের কবিতা লেখে,সে বয়সে সুকান্তের কবিতা আগুন জ্বেলে দিচ্ছে অসাম্যের বিরুদ্ধে,পূঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে।”বোধন” কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।শোষক ও শাসিতের অবসান কল্পে শোষিত ও শাসিতের জাগরণের কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের “বোধন”

    See less
  3. বিশ্বজননী মা টেরেসা ভূমিকা: মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ সেবা ও প্রেম। সেবা ও প্রেম দিয়ে যারা পৃথিবীর মানব সমাজে অমরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মাদার টেরেসা তাদের মধ্যে অন্যতম। শৈশবকাল থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত তিনি ছিলেন মানবসেবায় নিয়ােজিত প্রাণ। রােগগ্রস্ত শােক সন্তপ্ত মানুষের কাছে তিনি দেবমূর্তিRead more

    বিশ্বজননী মা টেরেসা

    ভূমিকা: মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ গুণ সেবা ও প্রেম। সেবা ও প্রেম দিয়ে যারা পৃথিবীর মানব সমাজে অমরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মাদার টেরেসা তাদের মধ্যে অন্যতম। শৈশবকাল থেকে বৃদ্ধাবস্থা পর্যন্ত তিনি ছিলেন মানবসেবায় নিয়ােজিত প্রাণ। রােগগ্রস্ত শােক সন্তপ্ত মানুষের কাছে তিনি দেবমূর্তি। তার সেবা যত্নে, আদর আর ভালবাসায় অগণিত মানুষ রােগ মুক্ত হয়ে স্বস্তি পেয়েছে, তার স্নেহধন্য হয়ে কেউ পরম সুখে জীবন যাপন করছে। আর্ত লােকদের অতি কাছের মানুষ ছিলেন মাদার টেরেসা।
    জন্ম ও বাল্য জীবন : টেরেসা মায়ের নিজের দেশ ভারতবর্ষ, যদিও তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১০ খৃষ্টাব্দের ২৭শে আগষ্ট যুগােশ্লাভিয়ার স্কপেজ শহরের এক আলবেনীয় দম্পতির ঘরে। তার পূর্বনাম অ্যাগনেস গংক্সা বােজাক্সিউ। বাল্যকালে পড়াশুনা শুরু হয় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে। স্কুলের পড়া-শুনা যেমন তার ভালাে লাগত তেমনি ভালাে লাগত সেবামূলক কাজ। স্কুলের শিক্ষিকার নিকট হতে জানতে পারেন যে সেবামলক কাজ করবার জন্য পথিবীতে বেশ কয়টি সংগঠন আছে। অ্যাগনেস মনে মনে স্থির করেন যে এ সব সংগঠনে যােগ দান করবেন। এর সঙ্গে এক অধ্যাত্ববােধও তার মনে বাসা বাঁধে, তাই মাত্র আঠারাে বছর বয়সে তিনি একটি খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হন।
    কর্মজীবন : মিশনারির ব্রত নেওয়ার পর তার নাম রাখা হয় টেরেসা। তারপর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ডাবলিনের লরেটো অ্যাবেতে ভারতের বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা শুনে তিনি ভারতবর্ষের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯২৮ খৃষ্টাব্দে মাদার ভারতে আসেন। প্রথমে মার্গারেট স্কুলে শিক্ষকতা, ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচালনা ও পরে অধ্যক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই শিক্ষকতার ফাকে বস্তির দুঃস্থ অসহায় মানুষের সেবা করতেন।
    সেবায় নিজেকে নিয়ােগ : ১৯৪৬ খৃষ্টাব্দে দার্জিলিং যাত্রার পথে টেরেসার জীবনে এক ভাবান্তর দেখা যায়। শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি একমাত্র সেবাব্রত গ্রহণে মনস্থ করেন। নীল পাড়যুক্ত সাদা সুতী শাড়ি পরিহিতা বিশ্বজননী মাদার এর এ সময় থেকে। শুরু হল জীবনের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়। ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করেন। পাটনা থেকে নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে তিনি এ বৎসরেই মতিঝিল বস্তিতে একটি বিদ্যালয় খুলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ’ প্রতিষ্ঠা। করেন। তাঁর শুভ প্রচেষ্টায় কলকাতার কালীঘাটে গড়ে উঠে মরণাপন্নদের জন্য আতুর ভবন নির্মল হৃদয়’। সােদপুরে ‘প্রেমনিবাস’, ‘নির্মলা কেনেডি কেন্দ্রের মতাে অগণিত প্রতিষ্ঠান দুঃস্থ, আতুর অসহায় মানুষের জন্য মাদার গড়ে তুলেন। ভারতের গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে আছে মাদাদের প্রতিষ্ঠান গুলি। ভারতে তার পরিচালিত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫, দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র দুই শতাধিক, কুষ্ঠ চিকিৎসাকেন্দ্র ৫৫টি। ভারতের বাইরেও তার সেবা প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে।
    সেবা কার্যের পুরস্কার : বিশ্বের নানাদেশ একের পর এক সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করেছে মাদারকে। ১৯৬২ সালে ফিলিপাইন্স সরকার মাদারের জন্য ঘােষণা করেছে ম্যাগসেসে পুরস্কার। ওই বছরই ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৪ সালে পােপ জন পল তাকে একটি বহুমূল্য গাড়ি উপহার দেন। ওই দামি গাড়ি বিক্রি করে মাদার সেই টাকায় একটি কুষ্ঠাশ্রম গড়ে তােলেন। ১৯৭২ সালে পান নেহেরু পুরস্কার। ১৯৭৯ সালের ১৭ই অক্টোবর তিনি শান্তির জন্য নােবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮০ সালে প্রদত্ত হয় ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’।
    আদর্শ : আত্ম প্রচার বিমুখ মা টেরেসা অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশবাসীর কাছে। সেবার এক নতুন আদর্শ গড়ে তুলেছিলেন। শুধু সেবা নয় তার সঙ্গে আন্তরিক ভালবাসায় মানুষকে কাছে টেনে এনেছেন। বাণী বা উপদেশ নয়, যে কোন অবস্থায় আর্তের পাশে দাড়িয়ে সেবা ও ভালবাসাই ছিল তার জীবনাদর্শ।
    উপসংহার : ১৯৯৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর এই মহীয়সী নারী পঞ্জভতে বিলীন হয়ে যান। মানুষ হারাল তাদের বিশ্ব জননীকে। মহৎকাজে তাঁর সাধ ছিল, তাই সাদ্যের অকুলান হয়নি। তার সেবাদর্শ ও মানব প্রীতি সর্বকালের মানুষকে প্রেরণা ও শক্তি যোগায়।মূর্তিমতি সেবারূপা মা টেরেসা মানুষের মনিকোঠায় পূজিত ও বন্দিতা হবেন

    See less
  4. আমার প্রিয় গ্রন্থ ভূমিকা: প্রিয় গ্রন্থ বলতে গেলেই মনে একটা সংকোচ আসে। কেননা আমার প্রিয় বইটি অন্যের কাছে প্রিয় নাও হতে পারে। তখন যদি কেউ আমার রুচি নিয়ে কটাক্ষ করে, তবে তা হবে আমার কাছে প্রচন্ড দুঃখের এবং লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু ভালো লাগা আর মন্দ লাগার কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আমার ভাললাগা একান্তইRead more

    আমার প্রিয় গ্রন্থ

    ভূমিকা: প্রিয় গ্রন্থ বলতে গেলেই মনে একটা সংকোচ আসে। কেননা আমার প্রিয় বইটি অন্যের কাছে প্রিয় নাও হতে পারে। তখন যদি কেউ আমার রুচি নিয়ে কটাক্ষ করে, তবে তা হবে আমার কাছে প্রচন্ড দুঃখের এবং লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু ভালো লাগা আর মন্দ লাগার কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আমার ভাললাগা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নিজের অভিজ্ঞতার সূত্রেই আমার প্রিয় গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু লেখার চেষ্টা করব।

    প্রিয় বইয়ের নাম : একটা ভালাে বই পড়া মানে নিজেকে আবিষ্কার করা। মানব দূষণের একমাত্র প্রতিষেধক বই। একটা ভাল বই মানুষের আত্মার সঙ্গীত।বইয়ের ভুবনে যখন আমি প্রবেশ করি আমার বুকের মধ্যে ভূলােক, দ্যুলােক জ্বলে উঠে। প্রতিদিনের জীবনের গ্লানি তুচ্ছ মনে হয়। তবে উপন্যাস পড়তেই আমার বেশি ভালাে লাগে। উপন্যাসের পৃথিবীতে আমার সবচাইতে প্রিয় উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচিত শ্রীকান্ত’।

    কেন শ্রীকান্ত প্রিয় : বড় প্রেম শুধু শুধু কাছেই টানে না ইহা কখনাে কখনাে দূরেও ঠেলিয়া দেয়। এই জীবনাদর্শের জন্যই শ্রীকান্ত সকলের কাছে যেমন প্রিয় তেমনি আমার কাছেও। এই উপন্যাসে সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং বাস্তবতা আমাদের টানটান বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দেয়। এক ভবঘুরে জীবনের কাহিনি রােমান্টিক প্রেমের আদর্শ আলেখ্যের নসি-কাথা রচনা করেছে। গল্পের কাহিনি পড়তে বসে আমি যেন শ্রীকান্তেরই সংস্করণ হয়ে পড়ি।

    শ্রীকান্ত উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য : চারটি খণ্ডে বিভক্ত ‘শ্রীকান্ত’ একটি সুবৃহৎ উপন্যাস। লেখক হিসাবে শরৎচন্দ্র শুধু বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক নন, জনপ্রিয় সাহিত্যিকও। শরৎসাহিত্যের প্রতি আমি যতটা আকর্ষণ অনুভব করি অন্যান্য সাহিত্যিকের সাহিত্যের প্রতি ততটা করি না। মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখের জোয়ার ভাটার কাহিনি নিয়েই লেখা ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি। দেশ, সমাজ, মানুষের জীবন যাত্রা, আচার-ব্যবহার, কুসংস্কার, ঝগড়া-ঝাটি, প্রেমপ্রীতি বিনিময় সবকিছুই এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। এত বড়াে পরিসর ও এতবেশি চরিত্র আর কোন উপন্যাসে নেই। তাই শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রতি আমার এত আকর্ষণ।

    প্রথম প্রিয় গ্রন্থ পাঠের অভিজ্ঞতা : এই উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় স্কুলের নিচের ক্লাসে। এই উপন্যাসের শ্রীনাথ বহুরূপী অংশটি পাঠের মাধ্যমে। এই ঘটনা শৈশবকালেই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আর একটু বড় হয়ে অর্থাৎ ক্লাস টেন-এ এসে পড়লাম নতুন দার’ অংশটি। দুটি অংশ ছােটবেলা থেকেই আমাকে নাড়া দিয়েছিল। মনে মনে বুঝলাম ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি হবে অতি সাধারণ বেশে অসাধারণের জীবন কথা।

    শ্রীকান্ত উপন্যাসে চরিত্র ও সমাজের বৈশিষ্ট্য : উপন্যাসটির মধ্যে আছে এক ভবঘুরের জীবন কাহিনি। শ্রীকান্তের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সে বহু জায়গায় গিয়েছে এবং বহু মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে। জীবন সম্পর্কে সে প্রথম দীক্ষা লাভ করেছিল ইন্দ্রনাথের কাছ থেকে। যে ইন্দ্রনাথ ছিল অসীম সাহসী ও অন্যের দুঃখে
    কাতর । যতক্ষণ সে এই উপন্যাসে উপস্থিত থেকেছে ততক্ষণ সমগ্র কাহিনি পেয়েছে তাব্ৰ গতি ও আকর্ষণীয় ঘটনার সম্ভার। তাছাড়া এই উপন্যাসের মেজদা চরিত্রটিও বড়ােই মজার। তাই এই চরিত্রটি পড়তে আমার বেশ মজাই লাগত। আর একটু পরিণত বয়সে বঝতে পারলাম এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে বাঙ্গালি চরিত্রের বিচিত্র সংগ্রহ শালা। বিশেষ করে নারী চরিত্রগুলি এ উপন্যাসে খুবই আকর্ষণীয়, যেমন – মাজলক্ষ্মী, অন্নদাদিদি, মেজদিদি, বড়দিদি, অভয়া প্রভৃতি চরিত্রগুলি আমাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।উপন্যাসটির মধ্যে বাস্তবতার পরিচয় আছে। তাছাড়া আছে মাতৃত্বের হাহাকার, খাঁটি প্রেমের মাধুর্য, ব্যর্থ-পেত কোথাও বা ভুল বােঝাবুঝি, কিন্তু সর্বত্রই বিরাজ করেছে মানবতার প্রতিষ্ঠা বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ।সমাজে যারা অবহেলিত, বঞ্চিত, শােষিত, , যাদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফুটে না – এ সব বিশেষ করে নারীদের স্বপক্ষে কলম ধরে তাদের কথা বলে গেছেন।

    উপন্যাসটিতে বাস্তবতা : শ্রীকান্ত মূলত আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস ।তাই এই উপন্যাসের সমস্ত বিষয়-আশয় ও চরিত্রের উপস্থাপনা বাস্তব অভিজ্ঞতার উপরে প্রতিষ্ঠিত, বাস্তবের মাটিতে গভীরভাবে সংযুক্ত, যদিও সাহিত্য শিল্পের খানি কিছুটা বাড়তি মশলার সংযােগ করতেই হয়। তথাপিও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও তার বিশ্বাসযােগ্যতা এই উপন্যাসটিকে আলাদা আসনে বসিয়েছে। তার লেখনিতে তুলে ধরা চরিত্রগুলি জীবন্ত, সজীব ইন্দ্রনাথ ডানপিটে, দুর্জয় সাহসী, অসাধারণ বাহুবলের অধিকারী, আবার তাঁর ছােট বুকটি অপরিসীম স্নেহ, করুণা ও মমতায় ভরা। এই উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলিও নারীত্বের মহিমায়, বঞ্চিত প্রেমের মহিমায় চিরসুন্দর।

    উপসংহার : আমি এই উপন্যাসটি বারবারই পড়ি। শ্রীকান্তের জীবন কাহিনি এক ভবঘুরের জীবন কাহিনি। তাঁর জীবন চলমান জীবন। কোন বন্ধন তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। কোন নারীর স্নেহ,প্রেম, ভালবাসা তাকে আটকে রাখতে পারে নি। শ্রীকান্ত চলমান জীবন-পথের পথিক। পরিশেষে এ কথাটি বলব আমার এ গ্রন্থটির লেখক শরৎচন্দ্রের জীবন সম্পর্কেও কৌতুহল জন্মেছে। একটু পড়াশুনা করে জেনেছি তাঁর জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে কতটুকু নিবিড় সম্পর্ক।

    See less
  5. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হচ্ছে তার কবি ও সাহিত্যিক। তাঁরাই মানব সভ্যতার আলােক স্তম্ভ। তাঁদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান দেয়, আনন্দ দেয়। কবিরা দেশ কালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের। রবীন্দ্রনাথ কিংবা সেক্সপিয়ারের সাRead more

    বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান

    ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হচ্ছে তার কবি ও সাহিত্যিক। তাঁরাই মানব সভ্যতার আলােক স্তম্ভ। তাঁদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান দেয়, আনন্দ দেয়। কবিরা দেশ কালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের। রবীন্দ্রনাথ কিংবা সেক্সপিয়ারের সাহিত্য শুধু ভারতবর্ষ বা ইংল্যাণ্ডকে নয় সমস্ত বিশ্ববাসীকে করেছে মুগ্ধ। আমরা দেখতে পাই বাংলা কাব্যজগতে কবি মহাকবির অভাব নেই। এদের মধ্য থেকে একজন প্রিয় কবিও নির্ণয় করা কঠিন ব্যাপার নয় যেখানে আছেন রবীন্দ্রনাথের মতাে প্রতিভাবান কালজয়ী কবি। যার কাছে আছে অনেক উচ্চ শ্রেণির কবি প্রতিভা – তাই তাে রবীন্দ্রনাথই আমার প্রিয় কবি।.

    বাংলার শ্রেষ্ট কবি : যেখানে রয়েছেন মধুসূদনের মতাে মহাকবি যিনি প্রাচ্য , ও পাশ্চাত্যের ভাণ্ডার থেকে নানা রত্ন আহরণ করে সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যের রুদ্ধ দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। যেখানে রয়েছেন ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা অগ্নিবীণার’ কবি নজরুল অথবা জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্যের ন্যায় আধুনিক কবিরা – সেখানে রবীন্দ্রনাথকে প্রিয় কবি রূপে দেখাতে গেলে স্বাভাবিকভাবে কথা উঠতে পারে। তবে এ-কথার উত্তর অতি সহজ। রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙ্গালীর কবি নন, নন। ভারতবাসীর, ইনি বিশ্বকবি যিনি বিশ্বের মানুষের মন জয় করেছেন। তাইতাে রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় কবি। যিনি নিঃশ্বাস বায়ুর ন্যায় জড়িয়ে আছেন সমগ্র বাঙ্গালীর সভায়।

    জন্ম ও বংশ পরিচয় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১সালের ৭ই মে, বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে। প্রকৃতই সােনার চামচ মুখে নিয়েই জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাম ঠাকুর ও মাতার নাম সারদা দেবী। পিতামহ সে যুগের সনামধন্য প্রিন্স দ্বারকান ঠাকুর । যে পরিবারে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন সে পরিবার ছিল সেকালের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির-শ্রেষ্ঠ পিঠস্থান।

    বাল্যকাল ও বিদ্যা শিক্ষা : শৈশবে গৃহ শিক্ষকের নিকট থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ হয়। পরে তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু বিদ্যালয়ের ” শিক্ষা-প্রণালী তার ভাল না লাগায় তিনি স্কুল পরিত্যাগ করেন। অবশ্য বিদ্যা করলেও বাড়িতে বিভিন্ন বিষয়ের গৃহ শিক্ষকের নিকট নিয়মিত পড়া-শুনা, তারপর মধ্যম ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ইংরেজি শিক্ষা করেন এবং সত্যেন্দ্র নাথের সঙ্গে বিলাত গিয়ে লণ্ডন ইউনিভারসিটি কলেজেও অধ্যয়ন করেন।

    কাব্য চর্চার সূচনাঃ কবি তাঁর জীবন স্মৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন – “আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশী হইবেনা। . একখানি নীল কাগজের খাতা জোগাড় করিলাম। তাহাতে স্বহস্তে পেন্সিল দিয়া কতকগুলি অসমান লাইন কাটিয়া বড় বড় কাচা অক্ষরে পদ্য লিখিতে শুরু করিয়া দিলাম।” অর্থাৎ সাত-আট বছর বয়স থেকেই কবির কবিতা রচনার আরম্ভ। তাছাড়া “জল পড়ে, পাতা নড়ে।” পংক্তি দুটি দিয়ে ছােট বেলার কাব্য রচনার সূত্রপাত হয়। তের বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘অভিলাস” “তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তার কবিত্ব শক্তির পরিচয় পেয়ে সকলেই বিস্মিত হন।তারপর একে একে তরুণ কবির কবিতা ‘ভারতী’ ‘সাধনা’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আলােড়নের সৃষ্টি করে। এর পর রবীন্দ্রনাথ ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, বাল্মীকী প্রতিভা প্রভৃতি কয়েকটি কবিতা রচনা করেন।

    কবির কাব্যসম্ভারঃ রবীন্দ্রনাথের কাব্য গুলির বিশেষ করে সাহিত্য চর্চার বিবরণ দিতে গিয়ে মনে হয় এ যেন একজন মানুষের একটি জীবনের ফসল মাত্র নয়। বােধ হয় এ জন্যই রবীন্দ্র রসজ্ঞ সাহিত্যিক প্ৰথমনাথ বিশী ব্যঙ্গের সুরে বলে ছিলেন যে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হয়তাে ভাববে রবীন্দ্রনাথ আসলে ছিলেন তিনজন – প্রথমজন। যিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করে সেখানেই লেখতেন। দ্বিতীয়জন বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই লেখতেন। আর তৃতীয় রবীন্দ্র নাথের বিচরণক্ষেত্র ছিল পূর্ববঙ্গের পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চল। সে যাই হােক ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত থেকে জন্মদিনে’ পর্যন্ত কবির কাব্যগ্রন্থ গুলিকে মােট ছয়টি পর্বে ভাগ করা যায়। ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’ থেকে ‘কড়ি ও কোমল পর্যন্ত প্রথম পর্ব, ২য় পর্ব পুনশ্চ’ থেকে ‘শ্যামলী পর্যন্ত কাব্য গুচ্ছ আর নৈবেদ্য’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব। পঞ্চম পর্বে রয়েছে গদ্য ছন্দে লেখা ‘মানসী’ থেকে ‘কল্পনা পর্যন্ত। প্রান্তিক থেকে জন্মদিনে’ পর্যন্ত কাব্যধারা নিয়ে গঠিত ষষ্ঠ বা শেষ পর্ব।

    নােবেল পুরস্কার লাভ : রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যখানি রচনা করেন ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। আর এ কাব্যখানির জন্যই ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার সাহিত্যে নােবেল প্রাইজ এশিয়ার মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাভ করেন এবং জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেন।

    কাব্যের প্রধান ধারা : রবীন্দ্র কাব্যে প্রধানতঃ তিনটি প্রধান ধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ধারাটি কবির প্রকৃতি চেতনা – প্রকৃতির প্রতি একটি তীব্র আকর্ষণ ও গভীর মমত্ববােধ রবীন্দ্রকাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। মানসী’, ‘সােনারতরী’, ‘চিত্রা’, “চৈতালী’ প্রভৃতি কাব্যে প্রকৃতি প্রীতির এই পরিচয় পাওয়া যায়। এ দ্বিতীয় ধারাটি মর্ত্য ও মানব প্রীতি যাকে তাঁর শ্রেষ্ঠ ধারা বলা যেতে পারে। তার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের দুর্ভাগাদেশ’, ‘ভারততীর্থ’, ‘দীনদান’ কবিতাগুলি বিশ্লেষণ করলেই সে পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়া তৃতীয় ধারার কাব্য ‘খেয়া’ কাব্যথেকে কবির আধ্যাত্ম ভাবনার স্রোত অতি গভীর হয়ে ওঠে এবং ‘গীতাঞ্জলি’ ও ‘গীতালি’ কাব্যে তার পরিণতি
    লক্ষ্য করা যায়।
    রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপ্রেম:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিশ্বপ্রেমিক, সুন্দরের পূজারী । তার কন্ঠ ছিল সুন্দর, কাব্য সঙ্গীত ছিল সুন্দর, গানে কবিতায় তিনি সুন্দরের মহিমা কীর্তন করে গেছেন ।সমাজ জীবনে যা কিছু অসুন্দর কুৎসিত এর মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। কবি পন্ডিত, দেশ প্রেমিক হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কত বড় ছিলেন তাঁর কথায় প্রকাশ করা যায় না।

    উপসংহার: বাঙালি জাতির পরম গৌরব যে রবীন্দ্রনাথের নেয়ায় প্রতিভাবান কবির জন্ম হয়েছিল বাংলার মাটিতে । আজ কবি আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তাঁর বাণী তথা কাব্য-কবিতা বাঙালি জাতিকে অন্ধকার হতে আলোর দিশা দেখাবে। যতদিন বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন কমের মরন নেই তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙালির জ্ঞানে কর্মে ও সাধনায়।

    See less
  6. This answer was edited.

    আবার আসিব ফিরে সারমর্ম ও বিষয়বস্তু : কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম বাংলাদেশে। তিনি নিজের জন্মভূমির নিসর্গ সৌন্দর্যে বিভাের। তিনি তাঁর সমগ্র সত্তা, সমগ্র চেতনা ও সমগ্র ব্যক্তিবােধের সমন্বয় খুঁজেছেন এই বাংলায়। অত্যন্ত গভীর ও অন্তর্লীন তাঁর সন্ধান। পাঠ্য কবিতায় এক চিত্ররূপময় বাংলার সৌন্দর্য প্রকাশিত হযRead more

    আবার আসিব ফিরে

    সারমর্ম ও বিষয়বস্তু : কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম বাংলাদেশে। তিনি নিজের জন্মভূমির নিসর্গ সৌন্দর্যে বিভাের। তিনি তাঁর সমগ্র সত্তা, সমগ্র চেতনা ও সমগ্র ব্যক্তিবােধের সমন্বয় খুঁজেছেন এই বাংলায়। অত্যন্ত গভীর ও অন্তর্লীন তাঁর সন্ধান। পাঠ্য কবিতায় এক চিত্ররূপময় বাংলার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। কবির ব্যক্তিসত্তার অভিনব প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায়।।

    কবির জন্ম ধানসিঁড়ি নদীর তীরে বরিশাল শহরে। তিনি মৃত্যুর পরেও বারে বারে ফিরে আসতে চান এই বাংলায়। মানুষ হয়ে ফিরে না-এলেও অন্য কোনও প্রাণীর রূপে বা অন্য কোনও ভাবে। তাই তিনি বলেন শঙ্খচিল বা শালিখের বেশে
    আসবেন। কার্তিকের নবান্নের দেশ এই বাংলাদেশে কুয়াশায় ভেসে ভেসে কাঁঠাল ছায়ায় আসবেন ভােরের কাক হয়ে। হয়তাে বা আসবেন হাঁস হয়ে। বাংলার নদী, মাঠ, ক্ষেত ভালোবেসে জলঙ্গি নদীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলা সবুজ ডাঙায় কবি ফিরে। আসতে চান হয়তাে কোনও সুদর্শন হয়ে বা শিমূল ডালে বসে থাকা লক্ষ্মীপ্যাচা বা কোনও ধবল বকের বেশে। কবির বিশ্বাস জন্ম-জন্মান্তর ধরে তাকে পাওয়া যাবে এই বাংলায় বিভিন্ন বেশে।

    কবিতার প্রেক্ষাপট: ১৯৪০ সালের দিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দিন এগুতে থাকলে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্ব ছিল ধর্মীয় সীমারেখায় ভারতের দিখন্ডতা। তৎকালীন মুসলিম লীগের লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন দেশের দাবি করেন। আর এই প্রেক্ষিতেই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয় পাকিস্তান ও ভারতবর্ষে। সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান ঘোষণা করা হয়। যার ফলে সমস্ত বাংলায় দেখা দেয় এক করুন ছবি। বাংলায় হিন্দু মুসলমান থাকলেও সবাই ছিল বাঙালি, তাদের বসবাস ছিল একত্রে, ছিল এক সংস্কৃতি আর ছিল মিলন, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। দেশভাগের ফলে অনেক মানুষ অনেক জায়গায় যেতে বাধ্য হয়। ছাড়তে বাধ্য হয়ে তাদের নিজ গ্রাম নিজ শহর, তাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

    আর কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার আর বেদনার কথা তুলে ধরেছেন এই কবিতার মাধ্যমে।

    মানুষের তার মাতৃভূমির প্রতি তাকে অফুরন্ত টান ও ভালোবাসা। তার মাতৃভূমি তাকে জড়িয়ে রাখে মাটির সঙ্গে মানুষের সঙ্গে। আর সেই ভালোবাসা সে কখনো ভুলতে পারে না। এইজন্য জীবনানন্দ দাশ বলেছেন আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়। যদিও মানুষকে তাদের প্রিয় ভূমি ছেড়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু তার ভালোবাসার টান এই মাটির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি তাকে হয়তো, আবারো নিয়ে আসবে এই বাংলায়।

     

    আবার আসিব ফিরে (abar asibo fire

    আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
    হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
    হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
    কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
    হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
    সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
    আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
    জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এই সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।

    হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
    হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
    হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
    রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
    ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
    দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

    See less
  7. আবার আসিব ফিরে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম বাংলাদেশে। তিনি নিজের জন্মভূমির নিসর্গ সৌন্দর্যে বিভাের। তিনি তাঁর সমগ্র সত্তা, সমগ্র চেতনা ও সমগ্র ব্যক্তিবােধের সমন্বয় খুঁজেছেন এই বাংলায়। অত্যন্ত গভীর ও অন্তর্লীন তাঁর সন্ধান। পাঠ্য কবিতায় এক চিত্ররূপময় বাংলার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। কবির ব্যক্তিসত্তাRead more

    আবার আসিব ফিরে

    কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম বাংলাদেশে। তিনি নিজের জন্মভূমির নিসর্গ
    সৌন্দর্যে বিভাের। তিনি তাঁর সমগ্র সত্তা, সমগ্র চেতনা ও সমগ্র ব্যক্তিবােধের সমন্বয়
    খুঁজেছেন এই বাংলায়। অত্যন্ত গভীর ও অন্তর্লীন তাঁর সন্ধান। পাঠ্য কবিতায় এক
    চিত্ররূপময় বাংলার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। কবির ব্যক্তিসত্তার অভিনব প্রকাশ
    ঘটেছে এই কবিতায়।।

    কবির জন্ম ধানসিঁড়ি নদীর তীরে বরিশাল শহরে। তিনি মৃত্যুর পরেও বারে
    বারে ফিরে আসতে চান এই বাংলায়। মানুষ হয়ে ফিরে না-এলেও অন্য কোনও
    প্রাণীর রূপে বা অন্য কোনও ভাবে। তাই তিনি বলেন শঙ্খচিল বা শালিখের বেশে
    আসবেন। কার্তিকের নবান্নের দেশ এই বাংলাদেশে কুয়াশায় ভেসে ভেসে কাঁঠাল
    ছায়ায় আসবেন ভােরের কাক হয়ে। হয়তাে বা আসবেন হাঁস হয়ে। বাংলার নদী,
    মাঠ, ক্ষেত ভালোবেসে জলঙ্গি নদীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলা সবুজ ডাঙায় কবি ফিরে।
    আসতে চান হয়তাে কোনও সুদর্শন হয়ে বা শিমূল ডালে বসে থাকা লক্ষ্মীপ্যাচা বা কোনও ধবল বকের বেশে। কবির বিশ্বাস জন্ম-জন্মান্তর ধরে তাকে এসবের
    ভিডিও দেখতে পাওয়া যাবে।

    See less
  8. "লুকোচুরি"-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি যদি দুষ্টুমি ক'রে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি, ভোরের বেলা মা গো, ডালের 'পরে কচি পাতায় করি লুটোপুটি, তবে তুমি আমার কাছে হারো, তখন কি মা চিনতে আমায় পারো। তুমি ডাক, "খোকা কোথায় ওরে।' আমি শুধু হাসি চুপটি করে। যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে সবই আমি দেখব নয়ন মেলে। স্নানটি করে চRead more

    “লুকোচুরি”-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    আমি যদি দুষ্টুমি ক’রে
    চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
    ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
    কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
    তবে তুমি আমার কাছে হারো,
    তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
    তুমি ডাক, “খোকা কোথায় ওরে।’
    আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
    যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
    সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
    স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
    আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
    এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
    দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে —
    তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
    তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
    দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
    বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
    গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
    পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
    আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
    দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি —
    তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
    তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
    সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
    যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
    তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
    টুপ্ করে মা, পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
    আবার আমি তোমার খোকা হব,
    “গল্প বলো’ তোমায় গিয়ে কব।
    তুমি বলবে, “দুষ্টু, ছিলি কোথা।’
    আমি বলব, “বলব না সে কথা ।

    See less
  9. দেনাপাওনা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিল নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্রচলিত ছিল– গণেশ, কার্তিক, পার্বতী, তাহার উদাহরণ। এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুনRead more

    দেনাপাওনা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

    পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিল নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্রচলিত ছিল– গণেশ, কার্তিক, পার্বতী, তাহার উদাহরণ।

    এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুন্দর মিত্র অনেক খোঁজ করেন কিন্তু পাত্র কিছুতেই মনের মতন হয় না। অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু বনেদি ঘর বটে।

    বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্রী চাহিয়া বসিল। রামসুন্দর কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন; এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড়া করা যায় না।

    কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না। বাঁধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া, অনেক চেষ্টাতেও হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল। এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে।

    অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না। বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল। রামসুন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া যাক, আমি নিশ্চয়ই টাকাটা শোধ করিয়া দিব।” রায়বাহাদুর বলিলেন, “টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না।”

    এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল। এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে চেলি পরিয়া, গহনা পরিয়া, কপালে চন্দন লেপিয়া, চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব একটা ভক্তি কিংবা অনুরাগ জন্মিতেছে, তাহা বলা যায় না।ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল। বর সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল। সে বাপকে বলিয়া বসিল, “কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না, বিবাহ করিতে আসিয়াছি বিবাহ করিয়া যাইব।”বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল, “দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার।” দুই-একজন প্রবীণ লোক ছিল, তাহারা বলিল, “শাস্ত্রশিক্ষা নীতিশিক্ষা একেবারে নাই, কাজেই।”বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন। বিবাহ একপ্রকার বিষণ্ন নিরানন্দ ভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল।

    শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চোখের জল রাখিতে পারিলেন না। নিরু জিজ্ঞাসা করিল, “তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না, বাবা।” রামসুন্দর বলিলেন, “কেন আসতে দেবে না, মা। আমি তোমাকে নিয়ে আসব।”

    রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান কিন্তু বেহাইবাড়িতে তাঁর কোনো প্রতিপত্তি নাই। চাকরগুলো পর্যন্ত তাঁহাকে নিচু নজরে দেখে। অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনোদিন-বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনোদিন-বা দেখিতে পাননা।কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া অপমান তো সহা যায় না। রামসুন্দর স্থির করিলেন যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে।কিন্তু যে ঋণভার কাঁধে চাপিয়াছে, তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য। খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি পড়িয়াছে; এবং পাওনাদারদের দৃষ্টিপথ এড়াইবার জন্য সর্বদাই নানারূপ হীন কৌশল অবলম্বন করিতে হইতেছে।

    এ দিকে শ্বশুরবাড়ি উঠিতে বসিতে মেয়েকে খোঁটা লাগাইতেছে। পিতৃগৃহের নিন্দা শুনিয়া ঘরে দ্বার দিয়া অশ্রুবিসর্জন তাহার নিত্যক্রিয়ার মধ্যে দাঁড়াইয়াছে।বিশেষত শাশুড়ির আক্রোশ আর কিছুতেই মেটে না। যদি কেহ বলে, “আহা, কী শ্রী। বউয়ের মুখখানি দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়।” শাশুড়ি ঝংকার দিয়া উঠিয়া বলে, “শ্রী তো ভারি। যেমন ঘরের মেয়ে তেমনি শ্রী।”

    এমন-কি, বউয়ের খাওয়াপরারও যত্ন হয় না। যদি কোনো দয়াপরতন্ত্র প্রতিবেশিনী কোনো ত্রুটির উল্লেখ করে, শাশুড়ি বলে, “ঐ ঢের হয়েছে।” অর্থাৎ বাপ যদি পুরা দাম দিত তো মেয়ে পুরা যত্ন পাইত। সকলেই এমন ভাব দেখায় যেন বধূর এখানে কোনো অধিকার নাই, ফাঁকি দিয়া প্রবেশ করিয়াছে।বোধ হয় কন্যার এই-সকল অনাদর এবং অপমানের কথা বাপের কানে গিয়া থাকিবে। তাই রামসুন্দর অবশেষে বসতবাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

    কিন্তু ছেলেদের যে গৃহহীন করিতে বসিয়াছেন সে কথা তাহাদের নিকট হইতে গোপেনে রাখিলেন। স্থির করিয়াছিলেন, বাড়ি বিক্রয় করিয়া সেই বাড়িই ভাড়া লইয়া বাস করিবেন; এমন কৌশলে চলিবেন যে, তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে এ কথা ছেলেরা জানিতে পারিবে না।কিন্তু ছেলেরা জানিতে পারিল। সকলে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল। বিশেষত বড়ো তিনটি ছেলে বিবাহিত এবং তাহাদের কাহারো-বা সন্তান আছে। তাহাদের আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল, বাড়ি বিক্রয় স্থগিত হইল।তখন রামসুন্দর নানাস্থান হইতে বিস্তর সুদে অল্প অল্প করিয়া টাকা ধার করিতে লাগিলেন। এমন হইল যে, সংসারের খরচ আর চলে না।

    নিরু বাপের মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল। বৃদ্ধের পক্ককেশে শুষ্কমুখে এবং সদাসংকুচিত ভাবে দৈন্য এবং দুশ্চিন্তা প্রকাশ হইয়া পড়িল। মেয়ের কাছে যখন বাপ অপরাধী তখন সে অপরাধের অনুতাপ কি আর গোপন রাখা যায়। রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে, তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইত।

    সেই ব্যথিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশে দিনকতক বাপের বাড়ি যাইবার জন্য নিরু নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছে। বাপের ম্লান মুখ দেখিয়া সে আর দূরে থাকিতে পারে না। একদিন রামসুন্দরকে কহিল, “বাবা, আমাকে একবার বাড়ি লইয়া যাও।” রামসুন্দর বলিলেন, “আচ্ছা।”

    কিন্তু তাঁহার কোনো জোর নাই– নিজের কন্যার উপরে পিতার যে স্বাভাবিক অধিকার আছে, তাহা যেন পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক রাখিতে হইয়াছে। এমন-কি, কন্যার দর্শন, সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময়বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখ থাকে না।

    কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাকে না আনিয়া কেমন করিয়া থাকে। তাই, বেহাইয়ের নিকট সে- সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে রামসুন্দর কত হীনতা, কত অপমান, কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো।

    নোট-কখানি রুমালে জড়াইয়া চাদরে বাঁধিয়া রামসুন্দর বেহাইয়ের নিকট গিয়া বসিলেন। প্রথমে হাস্যমুখে পাড়ার খবর পাড়িলেন। হরেকৃষ্ণের বাড়িতে একটা মস্ত চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত বিবরণ বলিলেন। নবীনমাধব ও রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে রাধামাধবের সুখ্যাতি এবং নবীনমাধবের নিন্দা করিলেন; শহরে একটা নূতন ব্যামো আসিয়াছে, সে- সম্বন্ধে অনেক আজগুবি আলোচনা করিলেন; অবশেষে হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কথায় কথায় বলিলেন, “হাঁ হাঁ বেহাই, সেই টাকাটা বাকি আছে বটে। রোজই মনে করি, যাচ্ছি অমনি হাতে করে কিছু নিয়ে যাই কিন্তু সময়কালে মনে থাকে না। আর ভাই, বুড়ো হয়ে পড়েছি।” এমনি এক দীর্ঘ ভূমিকা করিয়া পঞ্জরের তিনখানি অস্থির মতো সেই তিনখানি নোট যেন অতি সহজে অতি অবহেলে বাহির করিলেন। সবেমাত্র তিন হাজার টাকার নোট দেখিয়া রায়বাহাদুর অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন।বলিলেন, “থাক্‌ বেহাই, ওতে আমার কাজ নেই।” একটা প্রচলিত বাংলা প্রবাদের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, সামান্য কারণে হাতে দুর্গন্ধ করিতে তিনি চান না।

    এই ঘটনার পরে মেয়েকে বাড়ি আনিবার প্রস্তাব কাহারো মুখে আসে না– কেবল রামসুন্দর ভাবিলেন,”সে-সকল কুটুম্বিতার সংকোচ আমাকে আর শোভা পায় না।” মর্মাহতভাবে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে মৃদুস্বরে কথাটা পাড়িলেন। রায়বাহাদুর কোনো কারণমাত্র উল্লেখ না করিয়া বলিলেন, “সে এখন হচ্ছে না।” এই বলিয়া কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন।রামসুন্দর মেয়ের কাছে মুখ না দেখাইয়া কম্পিতহস্তে কয়েকখানি নোট চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।

    বহুদিন গেল। নিরুপমা লোকের উপর লোক পাঠায় কিন্তু বাপের দেখা পায় না। অবশেষে অভিমান করিয়া লোক পাঠানো বন্ধ করিল– তখন রামসুন্দরের মনে বড়ো আঘাত লাগিল, কিন্তু তবু গেলেন না।আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, “এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি”– খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন।

    পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল,”দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?” বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই।

    রামসুন্দর তাহা জানিতেন, এবং সে- সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসমান্য অলংকারে অনুগ্রহপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, এ কথা  স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর-কোনো ফল হয় নাই।

    দৈন্যপীড়িত গৃহের ক্রন্দনধ্বনি কানে লইয়া বৃদ্ধ তাঁহার বেহাইবাড়িতে প্রবেশ করিলেন। আজ তাঁহার সে সংকোচভাব নাই; দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যদের মুখের প্রতি সে চকিত সলজ্জ দৃষ্টিপাত দূর হইয়া গিয়াছে, যেন আপনার গৃহে প্রবেশ করিলেন। শুনিলেন, রায়বাহাদুর ঘরে নাই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে। মনের উচ্ছ্বাস সংবরণ করিতে না পারিয়া রামসুন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বাপও কাঁদে মেয়েও কাঁদে; দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না। এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল। তার পরে রামসুন্দর কহিলেন,”এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি, মা। আর কোনো গোল নাই।”

    এমন সময় রামসুন্দরের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহসা ঘরে প্রবেশ করিলেন। পিতাকে বলিলেন, “বাবা, আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে?”রামসুন্দর সহসা অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন, “তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব। আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে?” রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন; ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায়, তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, কিন্তু তবু তাহারা জানিয়াছে দেখিয়া তাহাদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।

    তাঁহার নাতি তাঁহার দুই হাঁটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, “দাদু আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না?”নতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া বলিল, “পিসিমা, আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে?”নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল, “বাবা, তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও, তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না, এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম।”

    রামসুন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান আর তোরও অপমান।”নিরু কহিল, “টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না। তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না।”রামসুন্দর কহিলেন, “তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা।”নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলো। তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ো না।”রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাঁধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন।

    কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে কথা গোপন রহিল না। কোনো স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণদাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল। শুনিয়া তাঁহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না।নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল। এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে; এবং পাছে সংসর্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয়, এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে।

    এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত। কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই। আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না। সে-যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল। কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না। যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন, তবে শাশুড়ি বলিতেন, “নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা। গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না।” কখনো-বা বলিতেন, “দেখো-না একবার, ছিরি হচ্ছে দেখো-না, দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে।”

    রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন, “ওঁর সমস্ত ন্যাকামি।” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল, “বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা।” শাশুড়ি বলিলেন, “কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল।”

    কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না– যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল, সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল, এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল।

    বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্রতিমাবিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরিদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে, বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রটিয়া গেল– এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনো দেখে নাই। এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব এবং শুনা যায়, ইহাতে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল।

    রামসুন্দরকে সান্ত্বনা দিবার সময় তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল।

    এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল, “আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি, অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে।” রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন, “বাবা তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে।”

    এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।

    See less
  10. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী ও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড তার কবি ও সাহিত্যিক। তারাই মানবসভ্যতার আলােকস্তম্ভ। তাদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ দেয়। সাহিত্যিকরা দেশকালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের মঙ্গলদৃত। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ইRead more

    শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী ও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান

    ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড তার কবি ও সাহিত্যিক। তারাই মানবসভ্যতার আলােকস্তম্ভ। তাদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ দেয়। সাহিত্যিকরা দেশকালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের মঙ্গলদৃত। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই আমার প্রিয় সাহিত্যিক যখন বঙ্কিম যুগ প্রায় অস্তমিত আর বাঙ্গালা সাহিত্যের আকাশে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা দীপ্তিতে ভাস্কর তখন বাংলার সাহিত্য গগনে আবির্ভাব আমার প্রিয় সাহিতিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।

    জন্ম ও বংশ পরিচয় : ১৮৭৬ সালে শরৎচন্দ্র হুগলী জেলার দেবানন্দপূরে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভূবন মােহিনা দেবী। শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশােরকাল অতিবাহিত হয় বিহারের ভগলপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হন কিন্তু এফ. এ. পরীক্ষার ফি দিতে অপারক হওয়ায় এখানেই তার পড়ার ইতি পড়ে।

    প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্র : যে কথা সাহিত্যে আছেন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যেখানে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , আর আছেন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক/উপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক বন্দোপাধ্যায় র মতাে সুনাম ধন্য লেখক/উপন্যাসিক সে জায়গায় শরৎচন্দ্রকে প্রিয় রূপে দেখাতে গেলে সে স্বাভাবিক ভাবে কথা উঠতেই পারে।কিন্তু শরৎসাহিত্য জগৎ আমাদের পরিচিত মৃত্তিকার জগৎ। এ জগতের প্রতিটি মানুষই আমাদের মতাে সুখকান্না, পতন, প্রেম, অশ্রু হাহাকার আলােড়নে বিলোড়ণে উচ্ছ্বসিত। তারা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, শােষিত, অত্যাচারিত- যাদের বুক ফটে তবুও মুখ না। শরৎচন্দ্র তাদের কথাই বলে গেছেন। তাইতাে শরৎচন্দ্র বাংলার সবচেয়ে দরদী ও জীবনরস পরিবেশনের রসিক লেখক/সাহিত্যিক/উপন্যাসিক।

    সাহিত্য চর্চার সুচনা ও সাহিত্য সম্ভার : মাত্র চৌদ্দবছর বয়সেই শরৎচন্দ্র ‘কাশীনাথ’ নামে একখানি উপন্যাস রচনা করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দির নামক গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। তারপর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্র অনিলা দেবী ছদ্ম নামে বড়দিদি উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তার রচিত ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’ পরিণত গল্প ও ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’, ‘দেনা পাওনা’, পথের দাবী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি উপন্যাস মানুষের স্নেহ-প্রীতি, কোমল হৃদয় বৃত্তি এবং চিরন্তন মানবিক দুর্বলতার বিষয় নিয়ে রচিত। সে জন্য এ সকল রচনা সহজেই পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। একমাত্র তার সাহিত্যেই আছে অসহায়, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানবাত্মার প্রতি সমবেদনা। সমাজ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত উত্থানপতনের মধ্যে বিচিত্র নর-নারীর বৈচিত্র্যময় রূপের কত বিপুল পরিচয় যে শরৎসাহিত্যে ছড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।

    শরৎ সাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিভা : শিল্পী বা সাহিত্যিক ভগবানের মতাে তার শিল্পের রাজ্যে সকলের প্রতিই তিনি সত্যের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। তবে সামাজিক, মানুষ হিসেবে বিশেষ বিশেষ করুণ চিত্রের প্রতি তার সহানুভূতি বিশেষভাবে প্রকট। এ জন্য তার গল্প বা উপন্যাসে দরিদ্রের প্রতি অসীম মমতা ছিল। সেকালে ম্যালেরিয়াপীড়িত, কলেরা-অধ্যষিত অনাহারে অর্ধহারে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দেশে উপনীত হওয়া মানুষগুলিকেই তিনি গভীর ভাবে ভালােবেসে ছিলেন। তাই শহর অপেক্ষা গ্রামের মানুষের প্রতি ছিল তার সহানুভূতি অতি প্রবল।

    শরৎসাহিত্যে নারী : শরৎ সাহিত্যে নারীকে উচ্চস্থানে বসানাে হয়েছে। পুরুষ-প্রধান সমাজে নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে তিনি যে সচেতন ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নারী শুধু যে স্বামীর ভােগ্য বস্তু, সম্পদ বা Commodity, এর বিরুদ্ধে তিনি সােচ্ছার হয়েছেন। পুরুষদের মতাে নারীও যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ এ কথা শরৎচন্দ্রের মতাে জোরের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আর কেউ বলেননি। তার উপন্যাসে অবহেলিত, অপমানিত, বঞ্চিত নায়িকা অল্প স্নেহ, ভালবাসায়, বাৎসল্যে বাঙ্গালীর গাহস্থ জীবনের কেন্দ্রে রাজেন্দ্রানী, অন্নপূর্ণার ন্যায় নারী যে বেশি। পরিমাণে দেখা গিয়েছে তা শরৎচন্দ্রের যে কোন গল্প বা উপন্যাসে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। রামের সমতি’তে নারায়ণই সর্বেসর্বা, ‘বিন্দুর ছেলে’তে বিন্দর দাপটে পরিবারের প্রতিটি নারী-পুরুষ নিম্প্রত হয়েছে। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস শ্রীকান্তে রাজলক্ষ্মী পুরুষ সমাজকে শাসন করছে।

    শরৎ সাহিত্যে প্রেম : পৃথিবীতে সকল অধিকারের উৎসই যে প্রেম এ কথাটি শরৎচন্দ্র একবারও আমাদিগকে ভুলতে দেননি। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জীবনানন্দের মতো লম্পট হৃদয়হীন জমিদার শেষপর্যন্ত ভালোবাসায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। শরৎসাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ এবং নারীকে শুধু ভালোবাসার মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আর যেখানে তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরহ প্রবল হয়ে উঠেছে সেখানেই দেখা গেছে যে তারা পারস্পরিক ভালোবাসা হতে বিচ্যুত। আমাদের মনে হয় চৈতন্যদেবের মত শরৎচন্দ্র হয়তো বক্তব্য ছিল যে ভালবাসায় মানুষের চরম পুরুষার্থ। কেননা এর মধ্যে নর নারী নিজেকে মহৎ করে তোলে।

    শরৎ সাহিত্যে বালক ও কিশাের চরিত্র : শরৎচন্দ্র বালক ও কিশোরদের মনের গহনে অবলীলাক্রমে ডুব দিতে পেরেছিলেন। ‘মেজদিদি’ উপন্যাসের অসহায়, দরিদ্র, সম্বলহীন নিরুপায় বিধবার একমাত্র সন্তান ১৪ বছরের কেষ্টর সাথে ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পের ‘অরণ্য’ অথবা অকাল পক্ক নরেন একই জীবন্ত সত্তা নিয়ে সমুপস্থিত। কলমের দু-একটি আঁচড়ে এই বালক ও কিশাের গুলির মান-অভিমান অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিতুগুলি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখলে অবাক লাগে, ‘রামের সমতির রামের ছেলে মনুষী ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কিশাের শ্রীকান্ত, চন্দ্রনাথ, সতীশ এবং অন্যান্য বেপরােয়া বালক গুলির কথা খুব সহজে ভুলা যায় না। কিশাের ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি তার এক অনবদ্য সৃষ্টি।

    শরৎ সাহিত্যে ভাষা : বস্তুত শরৎচন্দ্রের হাতে সহজ-সরল লােক চলিত ভাষার সঙ্গে আবেগ যুক্ত হয়ে এটি এমন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে যে পড়ামাত্র মর্মের ভিতরে গিয়ে সাড়া জাগায়। শরৎচন্দ্রের জন হৃদয় জয়ের অন্যতম কারণ এই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষা। এসব কারণেই বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।।

    উপসংহার : বাস্তবতা, নারীচরিত্র, পরুষ-চরিত্র, বালক ও কিশাের চরিত্র বর্ণনা ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎসাহিত্যের মােহময় জনপ্রিয়তার নিকট আর কোন বাঙ্গালি সাহিত্যিক বা উপন্যাসিক কাছাকাছিও আসতে পারবেন না । এখনও যদি পল্লী-বাংলার অর্ধ শিক্ষিত গৃহবধূ বলেন যে তিনি জীবনে মাত্র একখানি উপন্যাস কিংবা গল্প পড়েছেন তা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে নিঃসন্দে বলতে পারি যে উপন্যাস বা গল্পখানি শরৎচন্দ্রের লিখা। এসব কারণে শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় লেখক/সাহিত্যিক /উপন্যাসিক।

     

    See less