1. নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলেRead more

    নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

    ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক
    ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয়
    ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত
    আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলে ভারতবাসীর জন্য
    স্বাধীনতার সূর্য উদয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। শেষ পর্যন্ত যে তিনি সফল হননি সেটা
    রাজনীতির কুটচাল। তবে স্বদেশের মাটিতে উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীনতার পতাকা।
    তাই তাে আজও স্বদেশ বাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত ধ্বনি : জয়তু নেতাজী।

    জন্ম ও বাল্যজীবন : ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি ওড়িয্যার কটক
    শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তার পৈত্রিক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা কোদালিয়া গ্রামে।
    পিতার নাম জানকী নাথ বস ও মাতা প্রভাবতী দেবী। ছাত্র জীবনে সুভাষ এক দিকে
    যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুর্লভ মনোবলের অধিকারী। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি
    প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অতি শৈশব থেকেই তার মানব
    সেবার পরিচয় পাওয়া যায়। পিতা-মাতাকে লকিয়ে তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে আর্ত-পীড়িত
    রোগীদের সেবা-শুভশ্রী যা করতেন।

    ছাত্র জীবনের বলিষ্ঠতা : ছাত্র জীবনেই তিনি সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন –
    মাতৃভূমির বন্ধন মোচন ও আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার।এ
    কারণেই প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এ. পড়ার সময়ে অধ্যাপক ওটেনের বিরুদ্ধে রুখে
    দাড়িয়ে তিনি নিজ ভবিষ্যৎকে নষ্ট করেন। আর আই সি এস-এর লােভনীয় চাকুরি
    হেলায় ত্যাগ করে রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বেছে
    নেন দুঃখ, দারিদ্র ও নির্যাতনের এক অনিশ্চিত জীবন।

    স্বাধীনতা সংগ্রাম জীবনের ব্রত : ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক সুভাষ
    এক সফল ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কলেজ, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস
    কমিটি, দেশবন্ধুর স্বরাজ দল ও ফরওয়ার্ড পত্রিকা পরিচালনা ও সংগঠনে তিনি
    বিস্ময়কর সাফল্যের নজির রেখেছিলেন। তার কাছে রাজনীতি ও দেশসেবা ছিল ঈশ্বর
    সেবারই নামান্তর। বিভিন্ন জায়গায় বারংবার তিনি বলেছেন যে “এই আদর্শই আমার।
    জীবনের জপ-তপ ও স্বাধ্যায়।”

    নরম পন্থীদের সঙ্গে মতানৈক্য ও নিজ পথে সংগ্রাম : চরম পন্থী এই
    যুবনেতা সুভাষচন্দ্রের কাম্য ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা। এই মতাদর্শ নিয়ে
    জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাধে। অপর পক্ষে, সরকারের।
    চোখেও তিনি বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে গৃহবন্দি
    করে রাখে। কিন্তু সদা সতর্ক-পুলিশের চোখে ধূলি দিয়ে তিনি ছদ্মবেশে বিপদজনক
    দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শত্রুদেশে জার্মানিতে এসে উপস্থিত হন। ভারত মাতার
    মুক্তির জন্য জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলার তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। বিপ্লবী রাসবিহারী
    বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপদ সঙ্কুল সমুদ্র পথে পাড়ি দিয়ে জার্মানী থেকে জাপানে
    এসে উপস্থিত হন। সেখানে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে
    সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন ও তার পরিচালনা সুভাষচন্দ্রের
    জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আজাদী সেনাদলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল –“দিল্লি চলাে”।
    প্রেরণা তাদের নেতাজী।

    উপসংহার : নেতাজীর জীবনের রহস্যাবৃত পরিণতি দেশবাসীর মনকে
    আজও আলােড়িত করে চলেছে। তাই হাতে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল
    কিনা এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাশিয়ার মহাফেজখানা থেকে
    এমন কিছু তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে, যা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যের সম্বন্ধে
    সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিতি যুগ
    হতে যুগান্তরে মুক্তি সংগ্রামী মানুষের মনে চির ভাস্কর হয়ে থাকবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের
    সাহসিক আঘাতে কম্পমান ব্রিটিশ শক্তি বুঝেছিল ভারত থেকে বিদায়ের কাল সমাগত।
    ব্রিটিশ শাসক বদান্যতার পরিচয় দিয়ে তাদের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের কুহিনুর ভারত
    ছেড়ে চলে যায়নি। সাম্রাজ্যের নিয়তি লিপি পাঠ করেই তারা বিদায় নিয়েছে। তারপর
    থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত কাল শুরু হয়েছে। ‘Springing Tiger’ নেতাজীর
    শাণিত তরবারি সেই অন্তিম আঘাত হেনেছ।

    See less
  2. কখন - শুক্রবার রাত ১০টা ৩৭ নাগাদ শুরু হবে চন্দ্রগ্রহণ ৷ শেষ হবে ১১ জানুয়ারি, শনিবার রাত ২টো ৪২ মিনিটে ৷ মোট ৪ ঘণ্টা ০৫ মিনিটের জন্য থাকবে চন্দ্রগ্রহণ। এরমধ্যে মধ্যরাত ১২টা ৪০-এ সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে। কোথায় - এশিয়ার দেশগুলি যেমন ভারত বাংলাদেশ এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তরRead more

    কখন – শুক্রবার রাত ১০টা ৩৭ নাগাদ শুরু হবে চন্দ্রগ্রহণ ৷ শেষ হবে ১১ জানুয়ারি, শনিবার রাত ২টো ৪২ মিনিটে ৷ মোট ৪ ঘণ্টা ০৫ মিনিটের জন্য থাকবে চন্দ্রগ্রহণ।
    এরমধ্যে মধ্যরাত ১২টা ৪০-এ সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে।

    কোথায় – এশিয়ার দেশগুলি যেমন ভারত বাংলাদেশ এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব প্রান্তে দেখা যাবে।

    See less
  3. আমাদের মা – হুমায়ুন আজাদ আমাদের মাকে আমরা বলতাম ‘তুমি’,বাবাকে ‘আপনি’। আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে, কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না। আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি। আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো,কিন্তু ছিলো আমাদেRead more

    আমাদের মা – হুমায়ুন আজাদ

    আমাদের মাকে আমরা বলতাম ‘তুমি’,বাবাকে ‘আপনি’।

    আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
    কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।
    আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে মাকে আপনি বলার কথা আমাদের
    কোনোদিন মনেই হয়নি।
    আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো,কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
    আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর,আমাদের বর্ণের,আমাদের গোত্রের।
    বাবা ছিলেন অনেকটা ‘আল্লার’ মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
    বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
    মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
    ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
    আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
    আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
    আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
    আমাদের মা ছিলো দুধভাত তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
    আমাদের মা ছিলো ছোট্টপুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
    আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
    আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
    আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
    চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
    আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
    আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
    ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
    সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
    আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
    আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
    আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
    আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
    আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
    আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
    কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম
    থেকে নগর পর্যন্ত আমাদের মা আজো টলমল করে।

    See less
  4. উৎসর্গ - আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো আপনাকে, তোমাকে ও তোকে। কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা? কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন? কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন? কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত, তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত। কবিতা তো রূRead more

    উৎসর্গ –

    আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
    আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

    কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
    কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
    কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?

    কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
    চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
    তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

    কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
    খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
    কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
    মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
    সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
    তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।

    কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
    নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,-
    পথিক এ পথে নয়
    ‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।

    আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
    আপনাকে, তোমাকে ও তোকে

    See less
  5. বিড়াল আমি শয়নগৃহে, চারপায়ীর উপর বসিয়া, হুঁকা হাতে ঝিমাইতেছিলাম। একটু মিট্ মিট্ করিয়া ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে-দেয়ালের উপর চঞ্চল ছায়া, প্রেতবৎ নাচিতেছে। আহার প্রস্তুত হয় নাই-এজন্য হুঁকা হাতে, নিমীলিতলোচনে আমি ভাবিতেছিলাম যে, আমি যদি নেপোলিয়ন্ হইতাম, তবে ওয়াটার্লু জিতিতে পারিতাম কি না। এমত সময়ে একটি ক্ষুRead more

    বিড়াল

    আমি শয়নগৃহে, চারপায়ীর উপর বসিয়া, হুঁকা হাতে ঝিমাইতেছিলাম। একটু মিট্ মিট্ করিয়া ক্ষুদ্র আলো জ্বলিতেছে-দেয়ালের উপর চঞ্চল ছায়া, প্রেতবৎ নাচিতেছে। আহার প্রস্তুত হয় নাই-এজন্য হুঁকা হাতে, নিমীলিতলোচনে আমি ভাবিতেছিলাম যে, আমি যদি নেপোলিয়ন্ হইতাম, তবে ওয়াটার্লু জিতিতে পারিতাম কি না। এমত সময়ে একটি ক্ষুদ্র শব্দ হইল, “মেও!”

    চাহিয়া দেখিলাম-হঠাৎ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। প্রথমে মনে হইল, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হইয়া, আমার নিকট আফিঙ্গ ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে। প্রথম উদ্যমে, পাষাণবৎ কঠিন হইয়া, বলিব মনে করিলাম যে, ডিউক মহাশয়কে ইতিপূর্ব্বে যথোচিত পুরস্কার দেওয়া গিয়াছে, এক্ষণে আর অতিরিক্ত পুরস্কার দেওয়া যাইতে পারে না। বিশেষ অপরিমিত লোভ ভাল নহে। ডিউক বলিল, “মেও!”

    তখন চক্ষু চাহিয়া ভাল করিয়া দেখিলাম যে, ওয়েলিংটন নহে। একটি ক্ষুদ্র মার্জ্জার; প্রসন্ন আমার জন্য যে দুগ্ধ রাখিয়া গিয়াছিল, তাহা নিঃশেষ করিয়া উদরসাৎ করিয়াছে, আমি তখন ওয়াটার্লুর মাঠে ব্যুহ-রচনায় ব্যস্ত, অত দেখি নাই। এক্ষণে মার্জ্জারসুন্দরী, নির্জ্জাল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হইয়া আপন মনের সুখ এ জগতে প্রকটিত করিবার অভিপ্রায়ে, অতি মধুর স্বরে বলিতেছেন, “মেও!” বলিতে পারি না, বুঝি, তাহার ভিতর একটু ব্যঙ্গ ছিল; বুঝি, মার্জ্জার মনে মনে হাসিয়া আমার পানে চাহিয়া ভাবিতেছিল, “কেহ মরে বিল ছেঁচে, কেহ খায় কই।” বুঝি সে “মেও!” শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিল। বুঝি বিড়ালের মনের ভাব, “তোমার দুধ ত খাইয়া বসিয়া আছি-এখন বল কি?”

    বলি কি? আমি ত ঠিক করিতে পারিলাম না। দুধ আমার বাপেরও নয়। দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই; সুতরাং রাগ করিতে পারি না। তবে চিরাগত একটি প্রথা আছে যে, বিড়ালে দুধ খাইয়া গেলে, তাহাকে তাড়াইয়া মারিতে যাইতে হয়। আমি যে সেই চিরাগত প্রথার অবমাননা করিয়া মনুষ্যকুলে কুলাঙ্গার স্বরূপ পরিচিত হইব, ইহাও বাঞ্ছনীয় নহে। কি জানি, এই মার্জ্জারী যদি স্বজাতি-মণ্ডলে কমলাকান্তকে কাপুরুষ বলিয়া উপহাস করে? অতএব পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়। ইহা স্থির করিয়া, সকাতরচিত্তে, হস্ত হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করিয়া সগর্ব্বে মার্জ্জারী প্রতি ধাবমান হইলাম।
    মার্জ্জারী কমলাকান্তকে চিনিত; সে যষ্টি দেখিয়া বিশেষ ভীত হওয়ার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিল না। কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া হাই তুলিয়া, একটু সরিয়া বসিল। বলিল, “মেও!” প্রশ্ন বুঝিতে পারিয়া যষ্টি ত্যাগ করিয়া পুনরপি শয্যায় আসিয়া হুঁকা লইলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হইয়া, মার্জ্জারের বক্তব্যসকল বুঝিতে পারিলাম।

    বুঝিলাম যে, বিড়াল বলিতেছে, “মারপিট কেন? স্থির হইয়া হুঁকা হাতে করিয়া, একটু বিচার করিয়া দেখ দেখি? এ সংসারে ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস, সকলই তোমরা খাইবে, আমরা কিছু পাইব না কেন? তোমরা মনুষ্য, আমরা বিড়াল, প্রভেদ কি? তোমাদের ক্ষুৎপিপাসা আছে-আমাদের কি নাই? তোমরা খাও, আমাদের আপত্তি নাই; কিন্তু আমরা খাইলেই তোমরা কোন্ শাস্ত্রানুসারে ঠেঙ্গা লাঠি লইয়া মারিতে আইস, তাহা আমি বহু অনুসন্ধানে পাইলাম না। তোমরা আমার কাছে কিছু উপদেশ গ্রহণ কর। বিজ্ঞ চতুষ্পদের কাছে শিক্ষালাভ ব্যতীত তোমাদের জ্ঞানোন্নতির উপায়ান্তর দেখি না। তোমাদের বিদ্যালয়সকল দেখিয়া আমার বোধ হয়, তোমরা এত দিনে এ কথাটি বুঝিতে পারিয়াছ।

    “দেখ, শয্যাশায়ী মনুষ্য! ধর্ম্ম কি? পরোপকারই পরম ধর্ম্ম। এই দুগ্ধটুকু পান করিয়া আমার পরম উপকার হইয়াছে। তোমার আহরিত দুগ্ধে এই পরোপকার সিদ্ধ হইল-অতএব তুমি সেই পরম ধর্ম্মের ফলভাগী-আমি চুরিই করি, আর যাই করি, আমি তোমার ধর্ম্মসঞ্চয়ের মূলীভূত কারণ। অতএব আমাকে প্রহার না করিয়া, আমার প্রশংসা কর। আমি তোমার ধর্ম্মের সহায়।
    “দেখ, আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কি সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখ, যাঁহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেক চোর অপেক্ষাও অধার্ম্মিক। তাঁহাদের চুরি করিবার প্রয়োজন নাই বলিয়াই চুরি করেন না। কিন্তু তাঁহাদের প্রয়োজনাতীত ধন থাকিতেও চোরের প্রতি যে মুখ তুলিয়া চাহেন না, ইহাতেই চোরে চুরি করে। অধর্ম্ম চোরের নহে-চোরে যে চুরি করে, সে অধর্ম্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শত গুণে দোষী। চোরের দণ্ড হয়; চুরির মূল যে কৃপণ, তাহার দণ্ড হয় না কেন?
    “দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত, নর্দমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেট ভরা, আমার পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে! হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? আমার মত দরিদ্রের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া, লজ্জার কথা সন্দেহ নাই। যে কখন অন্ধকে মুষ্টি-ভিক্ষা দেয় না, সেও একটা বড় রাজা, ফাঁপরে পড়িলে রাত্রে ঘুমায় না-সকলেই পরের ব্যথায় ব্যথিত হইতে রাজি। তবে ছোটলোকের দুঃখে কাতর! ছি! কে হইবে?

    “দেখ, যদি অমুক শিরোমণি, কি অমুক ন্যায়ালঙ্কার আসিয়া তোমার দুধটুকু খাইয়া যাইতেন, তবে তুমি কি তাঁহাকে ঠেঙ্গা লইয়া মারিতে আসিতে? বরং যোড়হাত করিয়া বলিতে, আর একটু কি আনিয়া দিব? তবে আমার বেলা লাঠি কেন? তুমি বলিবে, তাঁহারা অতি পণ্ডিত, বড় মান্য লোক। পণ্ডিত বা মান্য বলিয়া কি আমার অপেক্ষা তাঁহাদের ক্ষুধা বেশী? তা ত নয়-তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ-দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না। যে খাইতে বলিলে বিরক্ত হয়, তাহার জন্য ভোজের আয়োজন কর-আর যে ক্ষুধার জ্বালায় বিনা আহ্বানেই তোমার অন্ন খাইয়া ফেলে, চোর বলিয়া তাহার দণ্ড কর-ছি! ছি!

    “দেখ, আমাদিগের দশা দেখ, দেখ প্রাচীরে প্রাচীরে, প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে, প্রাসাদে, প্রাসাদে, মেও মেও করিয়া আমরা চারি দিক্ দৃষ্টি করিতেছি-কেহ আমাদিগকে মাছের কাঁটাখানা ফেলিয়া দেয় না। যদি কেহ তোমাদের সোহাগের বিড়াল হইতে পারিল-গৃহমার্জ্জার হইয়া বৃদ্ধের নিকট যুবতী ভার্য্যার সহোদর, বা মূর্খ ধনীর কাছে সতরঞ্চ খেলওয়ারের স্থানীয় হইয়া থাকিতে পারিল-তবেই তাহার পুষ্টি। তাহার লেজ ফুলে, গায়ে লোম হয়, এবং তাহাদের রূপের ছটা দেখিয়া, অনেক মার্জ্জার কবি হইয়া পড়ে।

    “আর, আমাদিগের দশা দেখ-আহারাভাবে উদর কৃশ, অস্থি পরিদৃশ্যমান, লাঙ্গুল বিনত, দাঁত বাহির হইয়াছে-জিহ্বা ঝুলিয়া পড়িয়াছে-অবিরত আহারাভাবে ডাকিতেছি, ‘মেও! মেও! খাইতে পাই না!’- আমাদের কালো চামড়া দেখিয়া ঘৃণা করিও না! এ পৃথিবীর মৎস্য মাংসে আমাদের কিছু অধিকার আছে। খাইতে দাও-নহিলে চুরি করিব। আমাদের কৃষ্ণ চর্ম্ম, শুষ্ক মুখ, ক্ষীণ সকরুণ মেও মেও শুনিয়া তোমাদিগের কি দুঃখ হয় না? চোরের দণ্ড আছে, নির্দ্দয়তার কি দণ্ড নাই? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কার্পণ্যের দণ্ড নাই কেন? তুমি কমলাকান্ত, দূরদর্শী, কেন না আফিংখোর, তুমিও কি দেখিতে পাও না যে, ধনীর দোষেই দরিদ্র চোর হয়? পাঁচ শত দরিদ্রকে বঞ্চিত করিয়া একজনে পাঁচ শত লোকের আহার্য্য সংগ্রহ করিবে কেন? যদি করিল, তবে সে তাহার খাইয়া যাহা বাহিয়া পড়ে, তাহা দরিদ্রকে দিবে না কেন? যদি না দেয়, তবে দরিদ্র অবশ্য তাহার নিকট হইতে চুরি করিবে’; কেন না, অনাহারে মরিয়া যাইবার জন্য এ পৃথিবীতে কেহ আইসে নাই।”

    আমি আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলাম, “থাম! থাম মার্জ্জারপণ্ডিত! তোমার কথাগুলি ভারি সোশিয়ালিষ্টিক্! সমাজবিশৃঙ্খলার মূল! যদি যাহার যত ক্ষমতা, সে তত ধনসঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নির্ব্বিঘ্নে ভোগ করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধনসঞ্চয়ে যত্ন করিবে না। তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হইবে না।”

    মার্জ্জার বলিল, “না হইলে ত আমার কি? সমাজের ধনবৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধনবৃদ্ধি। ধনীর ধনবৃদ্ধি না হইলে দরিদ্রের কি ক্ষতি?”

    আমি বুঝাইয়া বলিলাম যে, “সামাজিক ধনবৃদ্ধি ব্যতীত সমাজের উন্নতি নাই।” বিড়াল রাগ করিয়া বলিল যে, “আমি যদি খাইতে না পাইলাম, তবে সমাজের উন্নতি লইয়া কি করিব?”
    বিড়ালকে বুঝান দায় হইল। যে বিচারক বা নৈয়ায়িক, কস্মিন্, কালে কেহ তাহাকে কিছু বুঝাইতে পারে না। এ মার্জ্জার সুবিচারক, এবং সুতার্কিকও বটে, সুতরাং না বুঝিবার পক্ষে ইহার অধিকার আছে। অতএব ইহার উপর রাগ না করিয়া বলিলাম, “সমাজের উন্নতিতে দরিদ্রের প্রয়োজন না থাকিলে না থাকিতে পারে, কিন্তু ধনীদিগের বিশেষ প্রয়োজন, অতএব চোরের দণ্ডবিধান কর্ত্তব্য।”

    মার্জ্জারী মহাশয়া বলিলেন, “চোরকে ফাঁসি দাও, তাহাতেও আমার আপত্তি নাই, কিন্তু তাহার সঙ্গে আর একটি নিয়ম কর। যে বিচারক চোরকে সাজা দিবেন, তিনি আগে তিন দিবস উপবাস করিবেন। তাহাতে যদি তাঁহার চুরি করিয়া খাইতে ইচ্ছা না করে, তবে তিনি স্বচ্ছন্দে চোরকে ফাঁসি দিবেন। তুমি আমাকে মারিতে লাঠি তুলিয়াছিলে, তুমি অদ্য হইতে তিন দিবস উপবাস করিয়া দেখ। তুমি যদি ইতিমধ্যে নসীরাম বাবুর ভাণ্ডারঘরে ধরা না পড়, তবে আমাকে ঠেঙ্গাইয়া মারিও, আমি আপত্তি করবি না।”

    বিজ্ঞ লোকের মত এই যে, যখন বিচারে পরাস্ত হইবে, তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ প্রদান করিবে। আমি সেই প্রথানুসারে মার্জ্জারকে বলিলাম যে, “এ সকল অতি নীতিবিরুদ্ধ কথা, ইহার আন্দোলনেও পাপ আছে। তুমি এ সকল দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া ধর্ম্মাচরণে মন দাও। তুমি যদি চাহ, তবে পাঠার্থে তোমাকে আমি নিউমান ও পার্করের গ্রন্থ দিতে পারি। আর কমলাকান্তের দপ্তর পড়িলেও কিছু উপকার হইতে পারে-আর কিছু হউক বা না হউক, আফিঙ্গের অসীম মহিমা বুঝিতে পারিবে। এক্ষণে স্বস্থানে গমন কর, প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দিবে বলিয়াছে, জলযোগের সময় আসিও, উভয় ভাগ করিয়া খাইব। অদ্য আর কাহারও হাঁড়ি খাইও না; বরং ক্ষুধায় যদি নিতান্ত অধীরা হও, তবে পুনর্ব্বার আসিও, এক সরিষাভোর আফিঙ্গ দিব।”
    মার্জ্জার বলিল, “আফিঙ্গের বিশেষ প্রয়োজন নাই, তবে হাঁড়ি খাওয়ার কথা, ক্ষুধানুসারে বিবেচনা করা যাইবে।”

    মার্জ্জার বিদায় হইল। একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হইতে আলোকে আনিয়াছি, ভাবিয়া কমলাকান্তের বড় আনন্দ হইল!

    শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্ত্তী

    See less
  6. নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলেRead more

    নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

    ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক
    ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয়
    ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত
    আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলে ভারতবাসীর জন্য
    স্বাধীনতার সূর্য উদয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। শেষ পর্যন্ত যে তিনি সফল হননি সেটা
    রাজনীতির কুটচাল। তবে স্বদেশের মাটিতে উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীনতার পতাকা।
    তাই তাে আজও স্বদেশ বাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত ধ্বনি : জয়তু নেতাজী।

    জন্ম ও বাল্যজীবন : ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি ওড়িয্যার কটক
    শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তার পৈত্রিক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা কোদালিয়া গ্রামে।
    পিতার নাম জানকী নাথ বস ও মাতা প্রভাবতী দেবী। ছাত্র জীবনে সুভাষ এক দিকে
    যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুর্লভ মনোবলের অধিকারী। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি
    প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অতি শৈশব থেকেই তার মানব
    সেবার পরিচয় পাওয়া যায়। পিতা-মাতাকে লকিয়ে তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে আর্ত-পীড়িত
    রোগীদের সেবা-শুভশ্রী যা করতেন।

    ছাত্র জীবনের বলিষ্ঠতা : ছাত্র জীবনেই তিনি সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন –
    মাতৃভূমির বন্ধন মোচন ও আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার।এ
    কারণেই প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এ. পড়ার সময়ে অধ্যাপক ওটেনের বিরুদ্ধে রুখে
    দাড়িয়ে তিনি নিজ ভবিষ্যৎকে নষ্ট করেন। আর আই সি এস-এর লােভনীয় চাকুরি
    হেলায় ত্যাগ করে রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বেছে
    নেন দুঃখ, দারিদ্র ও নির্যাতনের এক অনিশ্চিত জীবন।

    স্বাধীনতা সংগ্রাম জীবনের ব্রত : ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক সুভাষ
    এক সফল ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কলেজ, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস
    কমিটি, দেশবন্ধুর স্বরাজ দল ও ফরওয়ার্ড পত্রিকা পরিচালনা ও সংগঠনে তিনি
    বিস্ময়কর সাফল্যের নজির রেখেছিলেন। তার কাছে রাজনীতি ও দেশসেবা ছিল ঈশ্বর
    সেবারই নামান্তর। বিভিন্ন জায়গায় বারংবার তিনি বলেছেন যে “এই আদর্শই আমার।
    জীবনের জপ-তপ ও স্বাধ্যায়।”

    নরম পন্থীদের সঙ্গে মতানৈক্য ও নিজ পথে সংগ্রাম : চরম পন্থী এই
    যুবনেতা সুভাষচন্দ্রের কাম্য ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা। এই মতাদর্শ নিয়ে
    জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাধে। অপর পক্ষে, সরকারের।
    চোখেও তিনি বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে গৃহবন্দি
    করে রাখে। কিন্তু সদা সতর্ক-পুলিশের চোখে ধূলি দিয়ে তিনি ছদ্মবেশে বিপদজনক
    দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শত্রুদেশে জার্মানিতে এসে উপস্থিত হন। ভারত মাতার
    মুক্তির জন্য জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলার তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। বিপ্লবী রাসবিহারী
    বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপদ সঙ্কুল সমুদ্র পথে পাড়ি দিয়ে জার্মানী থেকে জাপানে
    এসে উপস্থিত হন। সেখানে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে
    সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন ও তার পরিচালনা সুভাষচন্দ্রের
    জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আজাদী সেনাদলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল –“দিল্লি চলাে”।
    প্রেরণা তাদের নেতাজী।

    উপসংহার : নেতাজীর জীবনের রহস্যাবৃত পরিণতি দেশবাসীর মনকে
    আজও আলােড়িত করে চলেছে। তাই হাতে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল
    কিনা এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাশিয়ার মহাফেজখানা থেকে
    এমন কিছু তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে, যা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যের সম্বন্ধে
    সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিতি যুগ
    হতে যুগান্তরে মুক্তি সংগ্রামী মানুষের মনে চির ভাস্কর হয়ে থাকবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের
    সাহসিক আঘাতে কম্পমান ব্রিটিশ শক্তি বুঝেছিল ভারত থেকে বিদায়ের কাল সমাগত।
    ব্রিটিশ শাসক বদান্যতার পরিচয় দিয়ে তাদের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের কুহিনুর ভারত
    ছেড়ে চলে যায়নি। সাম্রাজ্যের নিয়তি লিপি পাঠ করেই তারা বিদায় নিয়েছে। তারপর
    থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত কাল শুরু হয়েছে। ‘Springing Tiger’ নেতাজীর
    শাণিত তরবারি সেই অন্তিম আঘাত হেনেছ।

    See less
  7. নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলেRead more

    নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

    ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক
    ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয়
    ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত
    আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলে ভারতবাসীর জন্য
    স্বাধীনতার সূর্য উদয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। শেষ পর্যন্ত যে তিনি সফল হননি সেটা
    রাজনীতির কুটচাল। তবে স্বদেশের মাটিতে উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীনতার পতাকা।
    তাই তাে আজও স্বদেশ বাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত ধ্বনি : জয়তু নেতাজী।

    জন্ম ও বাল্যজীবন : ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি ওড়িয্যার কটক
    শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তার পৈত্রিক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা কোদালিয়া গ্রামে।
    পিতার নাম জানকী নাথ বস ও মাতা প্রভাবতী দেবী। ছাত্র জীবনে সুভাষ এক দিকে
    যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুর্লভ মনোবলের অধিকারী। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি
    প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অতি শৈশব থেকেই তার মানব
    সেবার পরিচয় পাওয়া যায়। পিতা-মাতাকে লকিয়ে তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে আর্ত-পীড়িত
    রোগীদের সেবা-শুভশ্রী যা করতেন।

    ছাত্র জীবনের বলিষ্ঠতা : ছাত্র জীবনেই তিনি সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন –
    মাতৃভূমির বন্ধন মোচন ও আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার।এ
    কারণেই প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এ. পড়ার সময়ে অধ্যাপক ওটেনের বিরুদ্ধে রুখে
    দাড়িয়ে তিনি নিজ ভবিষ্যৎকে নষ্ট করেন। আর আই সি এস-এর লােভনীয় চাকুরি
    হেলায় ত্যাগ করে রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বেছে
    নেন দুঃখ, দারিদ্র ও নির্যাতনের এক অনিশ্চিত জীবন।

    স্বাধীনতা সংগ্রাম জীবনের ব্রত : ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক সুভাষ
    এক সফল ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কলেজ, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস
    কমিটি, দেশবন্ধুর স্বরাজ দল ও ফরওয়ার্ড পত্রিকা পরিচালনা ও সংগঠনে তিনি
    বিস্ময়কর সাফল্যের নজির রেখেছিলেন। তার কাছে রাজনীতি ও দেশসেবা ছিল ঈশ্বর
    সেবারই নামান্তর। বিভিন্ন জায়গায় বারংবার তিনি বলেছেন যে “এই আদর্শই আমার।
    জীবনের জপ-তপ ও স্বাধ্যায়।”

    নরম পন্থীদের সঙ্গে মতানৈক্য ও নিজ পথে সংগ্রাম : চরম পন্থী এই
    যুবনেতা সুভাষচন্দ্রের কাম্য ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা। এই মতাদর্শ নিয়ে
    জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাধে। অপর পক্ষে, সরকারের।
    চোখেও তিনি বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে গৃহবন্দি
    করে রাখে। কিন্তু সদা সতর্ক-পুলিশের চোখে ধূলি দিয়ে তিনি ছদ্মবেশে বিপদজনক
    দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শত্রুদেশে জার্মানিতে এসে উপস্থিত হন। ভারত মাতার
    মুক্তির জন্য জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলার তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। বিপ্লবী রাসবিহারী
    বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপদ সঙ্কুল সমুদ্র পথে পাড়ি দিয়ে জার্মানী থেকে জাপানে
    এসে উপস্থিত হন। সেখানে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে
    সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন ও তার পরিচালনা সুভাষচন্দ্রের
    জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আজাদী সেনাদলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল –“দিল্লি চলাে”।
    প্রেরণা তাদের নেতাজী।

    উপসংহার : নেতাজীর জীবনের রহস্যাবৃত পরিণতি দেশবাসীর মনকে
    আজও আলােড়িত করে চলেছে। তাই হাতে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল
    কিনা এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাশিয়ার মহাফেজখানা থেকে
    এমন কিছু তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে, যা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যের সম্বন্ধে
    সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিতি যুগ
    হতে যুগান্তরে মুক্তি সংগ্রামী মানুষের মনে চির ভাস্কর হয়ে থাকবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের
    সাহসিক আঘাতে কম্পমান ব্রিটিশ শক্তি বুঝেছিল ভারত থেকে বিদায়ের কাল সমাগত।
    ব্রিটিশ শাসক বদান্যতার পরিচয় দিয়ে তাদের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের কুহিনুর ভারত
    ছেড়ে চলে যায়নি। সাম্রাজ্যের নিয়তি লিপি পাঠ করেই তারা বিদায় নিয়েছে। তারপর
    থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত কাল শুরু হয়েছে। ‘Springing Tiger’ নেতাজীর
    শাণিত তরবারি সেই অন্তিম আঘাত হেনেছ।

    See less
  8. নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলেRead more

    নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

    ভূমিকা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে একক শক্তি ও সাংগঠনিক
    ক্ষমতায় যিনি ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতার সূর্যোদয়
    ঘটিয়ে ছিলেন তার নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিনীত
    আবেদন-নিবেদন পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না সুভাষ। বাহুবলে ভারতবাসীর জন্য
    স্বাধীনতার সূর্য উদয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। শেষ পর্যন্ত যে তিনি সফল হননি সেটা
    রাজনীতির কুটচাল। তবে স্বদেশের মাটিতে উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীনতার পতাকা।
    তাই তাে আজও স্বদেশ বাসীর কণ্ঠে উচ্চারিত ধ্বনি : জয়তু নেতাজী।

    জন্ম ও বাল্যজীবন : ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি ওড়িয্যার কটক
    শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তার পৈত্রিক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা কোদালিয়া গ্রামে।
    পিতার নাম জানকী নাথ বস ও মাতা প্রভাবতী দেবী। ছাত্র জীবনে সুভাষ এক দিকে
    যেমন ছিলেন মেধাবী, তেমনি ছিলেন দুর্লভ মনোবলের অধিকারী। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি
    প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। অতি শৈশব থেকেই তার মানব
    সেবার পরিচয় পাওয়া যায়। পিতা-মাতাকে লকিয়ে তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে আর্ত-পীড়িত
    রোগীদের সেবা-শুভশ্রী যা করতেন।

    ছাত্র জীবনের বলিষ্ঠতা : ছাত্র জীবনেই তিনি সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন –
    মাতৃভূমির বন্ধন মোচন ও আর্তমানবতার সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার।এ
    কারণেই প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এ. পড়ার সময়ে অধ্যাপক ওটেনের বিরুদ্ধে রুখে
    দাড়িয়ে তিনি নিজ ভবিষ্যৎকে নষ্ট করেন। আর আই সি এস-এর লােভনীয় চাকুরি
    হেলায় ত্যাগ করে রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বেছে
    নেন দুঃখ, দারিদ্র ও নির্যাতনের এক অনিশ্চিত জীবন।

    স্বাধীনতা সংগ্রাম জীবনের ব্রত : ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক সুভাষ
    এক সফল ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কলেজ, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস
    কমিটি, দেশবন্ধুর স্বরাজ দল ও ফরওয়ার্ড পত্রিকা পরিচালনা ও সংগঠনে তিনি
    বিস্ময়কর সাফল্যের নজির রেখেছিলেন। তার কাছে রাজনীতি ও দেশসেবা ছিল ঈশ্বর
    সেবারই নামান্তর। বিভিন্ন জায়গায় বারংবার তিনি বলেছেন যে “এই আদর্শই আমার।
    জীবনের জপ-তপ ও স্বাধ্যায়।”

    নরম পন্থীদের সঙ্গে মতানৈক্য ও নিজ পথে সংগ্রাম : চরম পন্থী এই
    যুবনেতা সুভাষচন্দ্রের কাম্য ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত পূর্ণ স্বাধীনতা। এই মতাদর্শ নিয়ে
    জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাধে। অপর পক্ষে, সরকারের।
    চোখেও তিনি বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে গৃহবন্দি
    করে রাখে। কিন্তু সদা সতর্ক-পুলিশের চোখে ধূলি দিয়ে তিনি ছদ্মবেশে বিপদজনক
    দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শত্রুদেশে জার্মানিতে এসে উপস্থিত হন। ভারত মাতার
    মুক্তির জন্য জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলার তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। বিপ্লবী রাসবিহারী
    বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপদ সঙ্কুল সমুদ্র পথে পাড়ি দিয়ে জার্মানী থেকে জাপানে
    এসে উপস্থিত হন। সেখানে আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করে ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে
    সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন ও তার পরিচালনা সুভাষচন্দ্রের
    জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। আজাদী সেনাদলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল –“দিল্লি চলাে”।
    প্রেরণা তাদের নেতাজী।

    উপসংহার : নেতাজীর জীবনের রহস্যাবৃত পরিণতি দেশবাসীর মনকে
    আজও আলােড়িত করে চলেছে। তাই হাতে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল
    কিনা এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি রাশিয়ার মহাফেজখানা থেকে
    এমন কিছু তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে, যা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে প্রচারিত তথ্যের সম্বন্ধে
    সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিতি যুগ
    হতে যুগান্তরে মুক্তি সংগ্রামী মানুষের মনে চির ভাস্কর হয়ে থাকবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের
    সাহসিক আঘাতে কম্পমান ব্রিটিশ শক্তি বুঝেছিল ভারত থেকে বিদায়ের কাল সমাগত।
    ব্রিটিশ শাসক বদান্যতার পরিচয় দিয়ে তাদের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের কুহিনুর ভারত
    ছেড়ে চলে যায়নি। সাম্রাজ্যের নিয়তি লিপি পাঠ করেই তারা বিদায় নিয়েছে। তারপর
    থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত কাল শুরু হয়েছে। ‘Springing Tiger’ নেতাজীর
    শাণিত তরবারি সেই অন্তিম আঘাত হেনেছ।

    See less
  9. জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী  ভূমিকা : যে সমস্ত মানুষ পৃথিবীতে এসে তাদের মহাজীবনের অতি উজ্জ্বল আলাের দ্বারা মানুষের জীবনে কল্যাণের পথটি উদ্ভাসিত করে দেন মহাত্মা গান্ধী সেরূপ একজন মহাপুরুষ। ভারতবাসীকে তিনি এক নবমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। তাই তাই তিনি জাতির জনক। তার অপরাজেয় আত্মশক্তি সমগ্র দেশের প্রাণ শক্Read more

    জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী 

    ভূমিকা : যে সমস্ত মানুষ পৃথিবীতে এসে তাদের মহাজীবনের অতি
    উজ্জ্বল আলাের দ্বারা মানুষের জীবনে কল্যাণের পথটি উদ্ভাসিত করে দেন মহাত্মা গান্ধী
    সেরূপ একজন মহাপুরুষ। ভারতবাসীকে তিনি এক নবমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। তাই
    তাই তিনি জাতির জনক। তার অপরাজেয় আত্মশক্তি সমগ্র দেশের প্রাণ শক্তিকে
    জাগ্রত করেছিল। শুধু ভারতবর্ষ কেন সারা বিশ্বের তিনি একজন মহামানব।

    জন্ম ও শিক্ষা: ইংরেজি ১৮৬৯ সালের ২রা অক্টোবর গুজরাটের অন্তর্গত
    পােরবন্দরের এক সম্ত্রান্ত বণিক বংশে মহাত্মা গান্ধীর জন্ম। তার পুরাে নাম মােহন দাস
    করম চাদ গান্ধী। তাঁর পিতার নাম কাবা গান্ধী আর মাতার নাম পুতলিবাঈ। তার পিতা
    ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়-নিষ্ঠ ও তেজস্বী পুরুষ। আর মাতা ছিলেন ধর্মশীলা। গান্ধীজী
    বাল্যকালে অতিশয় ভীরু ও লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। গান্ধিজীর বিদ্যা শিক্ষা আরম্ভ
    হয় দেশীয় বিদ্যালয়ে। দশবছর বয়সে রাজকোটের উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে তার উচ্চশিক্ষা
    শুরু এবং সতের বছর বয়সে প্রবেশিকা পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভবন নগরের শ্যামল দাস
    কলেজে ভর্তি হন। কলেজে তাঁর বেশিদিন পড়ার সুযােগ হয়নি। দেশীয় প্রথামতে
    মাত্র তের বছর বয়সে কস্তুরীবাঈয়ের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।

    ব্যারিস্টারি পাস প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে
    গান্ধীজী ব্যারিস্টারি পাশ করবার জন্য বিলাত যান এবং ১৮৯০ খৃস্টাব্দে ব্যরিষ্টারি পাশ
    করে স্বদেশে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি মদ্য-মাংস স্পর্শ বা কোন আচার-বিরাে
    কার্য করবেন না বলে মায়ের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন
    করেছিলেন। আফ্রিকায় থাকা অবস্থায় সে দেশের বর্ণ বিদ্বেষী সরকারের বিদ্ধ
    সত্যনিষ্ঠ গান্ধীজী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

    কর্মজীবন : প্রথমে বােম্বাইয়ে, পরে রাজকোট শহরে তিনি আইন ব্যবসা
    আরম্ভ করেন। কিন্তু তার প্রকৃতিগত লাজুক স্বভাবের জন্য তিনি আইন ব্যবসায়ে ।
    প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেননি।১৮৯৩ খৃস্টাব্দে একটি জটিল মোকদ্দমার ভার নিয়ে গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার নাটলে গমন করেন। তার চেষ্টায় মোকদ্দমা আপসে মীমাংসা হয়ে গেলেও তিনি রয়ে
    গেলেন সেখানে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের লাঞ্ছনা ও নির্যাতন দেখে তিনি সকল
    প্রবাসী ভারতবাসীকে সম্মিলিত করে গড়ে তুলেন ‘নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস’ নামে
    একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের অধিকার রক্ষার জন্য চালাতে লাগলেন নানাভাবে আন্দোলন।
    এর ফলে সেতাঙ্গদের হাতে তাকে নানা প্রকার নির্যাতন ভােগ করতে হয়েছিল।দীর্ঘ একুশ বছর সেখানে বাস করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয়দের অধিকার। এখানেই
    তার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা।

    জীবন দর্শনের মূল সূত্র : গান্ধীজীর জীবনদর্শনের মূল ভিত্তিই সত্যের
    প্রতি মূল নিষ্ঠা। যার সমস্ত শক্তির উৎস ছিল সুগভীর মানবতাবোধ, কর্তব্য নিষ্ঠা ও
    ধর্মনিষ্ঠতা। গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন হিংসা দিয়ে কখনাে হিংসার উগ্রতাকে স্তব্ধ করা
    যায় না। অহিংসার শক্তি হিংসার শক্তির চেয়ে অনেকগুণ বেশি। গান্ধীজীর জীবন দর্শনের মূল ছিল আধ্যাত্ব চেতনা যা ছিল তাঁর প্রেরণা শক্তি। যে সত্যনিষ্ঠাকে তিনি ছেলেবেলা থেকে অনুসরণ করেছেন সেটাই তাকে পথ দেখিয়েছিল গভীর আধ্যাত্মিক বোধ ও বিশ্বাস।

    ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও গান্ধীজী : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে
    গান্ধীজীর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী। এই স্বাধীনতা
    যজ্ঞে তিনিই ছিলেন প্রধান ঋত্বিক। ১৯১৬ সালে নীলকরের অত্যাচারের প্রতিবাদে
    চম্পারণ তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ১৯১১ সালে রাওলাট বিলের প্রতিবাদে হরতাল
    ঘােষণা, ১৯২০ সালে ‘খিলাফত আন্দোলন ও ওই সালে অসহযোগ-নীতি গ্রহণ এবং
    বিলাতী-বর্জন আন্দোলন প্রভৃতি দ্বারা তিনি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতন
    অধ্যায়ের সূচনা করেন। ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি খদ্দর ও চরকা প্রচারে ব্রতী হয়ে
    আন্দোলন চালান। ভারতকে স্বায়ত্ব-শাসন দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার গােলটেবিল
    বৈঠকের আয়োজন করেন গান্ধীজী বিলাত যান এবং ১৯৩৯ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে
    শূন্য হাতে ফিরে আসে। ১৯৪২ খৃষ্টাব্দে “ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে
    গান্ধী ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে তার আত্মিক শক্তি দুর্জয় রূপ দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে।
    চকিত করে দেন। বস্তুত এভাবে ধারাবাহিক আন্দোলনে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি।
    ত্বরান্বিত হয়েছে। তিনি জীবনে বহুবার কারাবরণ করেন।

    সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও গান্ধীজী – গান্ধীজীর স্বাধীনতার জন্য
    সংগ্রাম তথা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুধু সরকার বদল বা শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের
    রাজনীতি নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক স্বাধীনতা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক
    স্বাধীনতার সঙ্গে এক সুত্রে জড়িত। তাই সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসমতার
    বিরুদ্ধে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন প্রথম থেকে। ভারতবর্ষের মাটিতে এক নতুন
    সমাজতন্ত্রের সাধনার প্রবক্তা ছিলেন গান্ধীজী। শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ এবং ব্যাপক কুটির শিল্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভারতে নব্য আর্থ সামাজিক কাঠামোর হদিশ
    দিয়েছেন তিনিই।

    গান্ধীজী ও মানবপ্রেম : গান্ধীজী ছিলেন প্রেমের পূজারী। তিনি মানব
    সেবক, তরি মানব প্রেম সমাজসেবার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল। তিনি হিন্দু-সমাজের
    অস্পৃশ্যতা-রূপ পাপ দূর করবার জন্য চষ্টা করে গেছেন। অস্পৃশাদের তিনি নাম
    দিয়েছিলেন হরিজন’। হিন্দু ও মুসলমানদের সম্প্রীতিকে তিনি দৃঢ় করার প্রয়াস চালিয়ে
    গিয়েছিলেন। গ্রাম প্রধান ভারতের পুনর্গঠনের জন্যও তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে
    গিয়েছেন। ভারতবর্ষের সাত লক্ষ শ্রীহীন গ্রামের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য তার
    অবদান স্মরণীয়।

    উপসংহার : গান্ধীজীর জীবন দর্শন ও ভারতাত্মা শাশ্বত বাণী সংহত
    মূর্তি। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসের পিস্তলের গুলিতে তার নশ্বর।
    দেহ লীন হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি চিরঞ্জীবী। আজও তার আরম্ভ করা কাজ সমাপ্ত
    হয়নি। ভারতের যতটুকু অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে, তা তারই প্রদর্শিত পথে এগিয়ে
    চলার ফল। তবে এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। দেশ থেকে দারিদ্র্য,
    অশিক্ষা, বিভেদ নীতি আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে। তাহলে
    দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে,মানব সমাজ বিপদ মুক্ত হবে। আর এই সাধনায় গান্ধীজীর
    জীবন দর্শন হবে আমাদের পরম পাথেয়।

    See less