Bengali Forum Latest Questions

  1. This answer was edited.

    মাতৃভাষার গুরুত্ব  বা শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা ভূমিকা : মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বােধের উন্মেষ। মাতৃভাষার মধ্যদিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে। শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমনই গুরুত্ব। মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবনRead more

    মাতৃভাষার গুরুত্ব  বা শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা

    ভূমিকা : মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বােধের উন্মেষ। মাতৃভাষার মধ্যদিয়ে শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে। শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমনই গুরুত্ব। মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে।

    সার্বিক বিকাশে মাতৃভাষা : মাতৃভূমির মতাে মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয়। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব। মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি। কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ ঘটে।

    বিদেশি ভাষার অসুবিধা : শিক্ষার মাধ্যমরূপে বিদেশি ভাষাকে অবলম্বন করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। তার কতকগুলি কারণ আছে। প্রথমতঃ বিদেশি ভাষাকে আয়ত্ত করতে যে কোন মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। দ্বিতীয়তঃ বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা যতই করায়ত্ত হােক না কেন তার মাধ্যমে মাতৃভাষার মতাে মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না।

    শিক্ষার লক্ষ্য : শিক্ষা ও জীবনের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের জন্য মাধ্যম হওয়া উচিত মাতৃভাষা। একমাত্র মাতৃভাষাই পারে প্রাণের ভাবের সম্মিলন ঘটাতে। শুধ কাজ নয়, ভাব প্রকাশই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।মাতৃভাষাই মানুষের মুক্তির যথার্থ উপায়। মাতভাষায় শিক্ষাগ্রহণে আপামর জনসাধারণের পক্ষে সহজ। গভীর আনন্দে মানষ শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষা তার পক্ষে ভার হয়ে দাড়ায় না। মাতৃভাষা শিক্ষা নেওয়ার পরে মানুষ নিজের ইচ্ছেমতাে যে কোন ভাষায় শিক্ষা নিতে পারে।

    বাংলা ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সূচনা : জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রটি আজও দুর্বল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে হডরােপায় মিশনারিদের চেষ্টায় এদেশে সর্বপ্রথম বাংলাভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সত্রপাত ঘটে। রাজা রামমােহন রায় সর্বপ্রথম এই ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখােপাধ্যায়, কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব লাভ করে।
    পরাধীন ভারতে রাষ্ট্রভাষা : পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজিই ছিল রাষ্ট্রভাষা। তখন শিক্ষার মাধ্যমরূপে একমাত্র ইংরেজি ভাষাই ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। ইংরেজি সভ্যতা ও সাহিত্যের অনেক গুণগত উৎকর্ষ আছে সেটি আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে। কিন্তু তবুও মাতৃভাষার স্থান সকলের চেয়ে আলাদা। ইংরেজি শিক্ষার মােহে সেই সময় শিক্ষিত যুবকবৃন্দ একস্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন সেই মােহ কাটল, তখন তাদের মধ্যে অনেকেই সত্য পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। মাইকেল মধুসুদন দত্ত ইংরেজি ভাষায় মহাকবি হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ইংরেজি ছেড়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে সাহিত্যরচনা করতে আরম্ভ করেন।

    বাংলা ভাষার ধারণ ক্ষমতা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। অনেকে হয়তাে যুক্তি দেখাবেন যে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার পথই একমাত্র পথ কারণ কিছু বিষয় | যেমন অর্থনীতি, ভূতত্ত্ববিদ্যা, বিজ্ঞান বিষয় সমূহকে মাতৃভাষার মাধ্যমে যথার্থ শিক্ষাদান সম্ভব হয় না। একথা হয়তাে আংশিক সত্য। কিন্তু তবুও অনুপযুক্ত বলে চিরকালই তা অনুপযুক্তই থাকবে এমন কোন কথা নেই।

    উপসংহার : মাতৃভাষা যে শিক্ষার সর্বস্তরে মাধ্যম হিসাবে কার্যত গৃহিত হতে পারছে না এর মূলে পণ্ডিত অধ্যাপকদের মানসিক জাড্য এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি মােহ। বাংলায় যে সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থাদি রচিত হয়নি তার দায় পণ্ডিত সমাজ অস্বীকার করতে পারবে না। জাপান-রাশিয়া-জার্মানি সূচনা থেকেই মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ স্তরের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়ােগ করেছেন। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা বাংলা সে বিষয়ে অক্ষম একথা স্বীকার করা যায় না। শুধু প্রতিষ্ঠানিক বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে বাংলা তথা অন্যান্য মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে রাখা লজ্জাকর। শিক্ষাকে সার্বজনীন ও উচ্চমানের করতে হলে মাতৃভাষার প্রতি এই মনােভাব অবশ্য বর্জন করতে হবে।

    See less
  1. ভূমিকম্প ভূমিকা : ধীর, শান্ত মানুষ যেমনি একেক সময় প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়, ঠিক সেভাবে প্রকতিও যেন একেকবার একেক রূপে প্রকাশ কে রুদ্রমূর্তি। খরা, বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত, জলোচ্ছাসের মতাে ভূমিকম্প প্রকৃতির একটি ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। ভূমিকম্পের কারণ : পথিবীর অভ্যন্তরে তাপ, চাপ, গ্রাস প্রভৃতির ভারসাম্য নষ্Read more

    ভূমিকম্প

    ভূমিকা : ধীর, শান্ত মানুষ যেমনি একেক সময় প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়, ঠিক সেভাবে প্রকতিও যেন একেকবার একেক রূপে প্রকাশ কে রুদ্রমূর্তি। খরা, বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত, জলোচ্ছাসের মতাে ভূমিকম্প প্রকৃতির একটি ভয়ঙ্কর দুর্যোগ।

    ভূমিকম্পের কারণ : পথিবীর অভ্যন্তরে তাপ, চাপ, গ্রাস প্রভৃতির ভারসাম্য নষ্ট হলেই প্রচণ্ড আলােড়নের সৃষ্টি হয়। আর তারই ফলে ভীষণভাবে প্রকম্পিতা হন বসুন্ধরা। প্রকৃতির রােষতপ্ত এই প্রলয় নাচনে তখন চোখের পলকে নির্মমভাবে শেষ হয়ে যায় সভ্য মানুষের সাজানাে বাগান – অকাতরে নষ্ট হয় শতশত প্রাণ ও সম্পত্তি । হাহাকারে ভরে যায় আকাশ-বাতাস। আর বিজ্ঞানের দানে অন্ধ ভােগবদিী মানুষ তখন শুধুই নির্বাক দর্শক, নিরূপায় শিকার। পৃথিবীতে বার বার ঘটে গেছে এমনকী প্রয়লংকার ভূমিকম্পের তাণ্ডব।

    অতীতে ভূমিকম্প : বর্তমানের ন্যায় অতীতেও পৃথিবীতে বহু ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে গেছে। ইতিহাসের তত্ত্বমতে খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০ অব্দে ভূমিকম্পের ফলে ক্রীট দ্বীপের সভ্যতাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৭০৩ সালে জাপানের টোকিও শহরে, ১৭৩৭ সালে কলকাতায়, ভূমিকম্প ছিল মারাত্মক। ১৯৫০ সালে আসামের ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদের গতি পথটাই পালটে দিয়েছিল। ২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারি গুজরাটের ভূমিকম্প ছিল ভারতের ভয়ঙ্করতম ভূমিকম্পগুলির মধ্যে দ্বিতীয়। এই ভূমিকম্পে তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়েছিল সাজানাে সভ্যতার ইমারতগুলি। এই ভয়াবহ ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫০,০০০ মানুষ।

    সাম্প্রতিককালে ভূমিকম্প : ২০০৫ সালের ৮ অক্টোবর বাংলায় যখন শারদীয়া উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে তখনই ভারতীয় সময় সকাল ৯-২০ মিনিটে। কেঁপে উঠে সমগ্র কাশ্মীর, পাকিস্থান, আফগানিস্থান এবং উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। রিখটার স্কেলে এই কম্পণের সর্বোচ্চ তীব্রতা ছিল ৭.৫। এই ভূমিকম্পের উৎস ছিল পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের উত্তর পশ্চিমে শিপাল মসজিদ এলাকায়। এই ভূমিকম্পে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ নিহত হয়। আহত ও নিখোঁজ হয় আরও বহু মানুষ। ২৫ এপ্রিল ২০১৫ইং তারিখে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালের ভূমিকম্প পূর্বে বর্ণিত ভূমিকম্পগুলি থেকে কম মারাত্মক ছিল না। এ ভূমিকম্পে ১০,০০০ এরও অধিক লােক নিহত হয়। সাম্প্রতিককালে ২০১৬ইং ৩রা জানুয়ারি ভারতের হম্মল, আসাম ও এদের আশপাশ অঞ্চলে ভূমিকম্প তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সাবধানবাণী জানান দিয়ে গেল।
    ত্রাণকার্য : ভূকম্পনের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে দেশ জুড়ে শুরু হয় ত্রাণের তৎপরতা। মানুষ সামাজিক জীব তাই মানুষ দুর্গত মানুষকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন সংঘটনও উদ্ধার কার্যে ঝাপিয়ে পড়ে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায় ত্রাণ সামগ্রী খাদ্য, ঔষধ ইত্যাদি নিয়ে । ভারত শুধু নিজের দেশেই নয়, প্রতিবেশী পাকিস্তান, নেপাল, চীন প্রবৃত্তি দেশের জন্য ত্রাণ সামগ্রী পাঠায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী বিপুল উদ্যমে ত্রাণ ও উদ্ধারে ঝাপিয়ে পড়ে।
    ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিরােধের ভাবনা : ভূমিকম্প এক বিরাট সাত বিপর্যয়। মানুষের নিশ্চিন্ত জীবনে আচমকা ঝাপিয়ে পড়ে এই বিপদ। ‘ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির হার মারাত্মক রকমের। মানুষের কত সাধনায় সাজানাে সে চুরমার হয়ে যায় এক লহমায়। অসংখ্য মানুষ, পশু-পাখির প্রাণ ঝরে যায় পাতার মতাে। কিন্তু প্রকৃতির এই করাল অভিশাপের খবর আগাম পেতে যে ব্যবহার হয়, তা পৃথিবীর মুষ্টিমেয় কয়েকটি ধনী দেশেরই করায়ত্ত। আমাদের কে এই যন্ত্র বসানাে হয়েছে – এটা সুখের বিষয়। আশা করা যায় এর সাহায্যে ভাবান ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের বিপর্যয় এড়াতে পারবে।

    উপসংহার : একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষের বিজ্ঞান-বুদ্ধির বড়াইকে বুড়াে আঙ্গুল দেখিয়ে চরম বিদ্রুপ করেছে। মানুষ ভুমিকম্পের আগাম বার্তা পেতে শিখেছে, কম্পনের তীব্রতাকে মাপজোখ করতে শিখেছে। কিন্তু তার হাত থেকে। নিজেকে বাঁচানাের ব্যবস্থা করতে আজও শেখেনি। হয়তাে শেখা সম্ভবও নয়। কেননা, প্রকৃতির বিশালতা ও প্রচণ্ডতার কাছে মানুষের দুর্দশা বুঝি কোনমতেই ঘােচাবার নয়।

    See less
  1. দেনাপাওনা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিল নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্রচলিত ছিল-- গণেশ, কার্তিক, পার্বতী, তাহার উদাহরণ। এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুRead more

    দেনাপাওনা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

    পাঁচ ছেলের পর যখন এক কন্যা জন্মিল তখন বাপমায়ে অনেক আদর করিয়া তাহার নাম রাখিল নিরুপমা। এ গোষ্ঠীতে এমন শৌখিন নাম ইতিপূর্বে কখনো শোনা যায় নাই। প্রায় ঠাকুরদেবতার নামই প্রচলিত ছিল– গণেশ, কার্তিক, পার্বতী, তাহার উদাহরণ।

    এখন নিরুপমার বিবাহের প্রস্তাব চলিতেছে। তাহার পিতা রামসুন্দর মিত্র অনেক খোঁজ করেন কিন্তু পাত্র কিছুতেই মনের মতন হয় না। অবশেষে মস্ত এক রায়বাহাদুরের ঘরের একমাত্র ছেলেকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। উক্ত রায়বাহাদুরের পৈতৃক বিষয়-আশয় যদিও অনেক হ্রাস হইয়া আসিয়াছে কিন্তু বনেদি ঘর বটে।

    বরপক্ষ হইতে দশ হাজার টাকা পণ এবং বহুল দানসামগ্রী চাহিয়া বসিল। রামসুন্দর কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া তাহাতেই সম্মত হইলেন; এমন পাত্র কোনোমতে হাতছাড়া করা যায় না।

    কিছুতেই টাকার জোগাড় আর হয় না। বাঁধা দিয়া, বিক্রয় করিয়া, অনেক চেষ্টাতেও হাজার ছয়-সাত বাকি রহিল। এ দিকে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিয়াছে।

    অবশেষে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। নিতান্ত অতিরিক্ত সুদে একজন বাকি টাকাটা ধার দিতে স্বীকার করিয়াছিল কিন্তু সময়কালে সে উপস্থিত হইল না। বিবাহসভায় একটা তুমুল গোলযোগ বাধিয়া গেল। রামসুন্দর আমাদের রায়বাহাদুরের হাতে-পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “শুভকার্য সম্পন্ন হইয়া যাক, আমি নিশ্চয়ই টাকাটা শোধ করিয়া দিব।” রায়বাহাদুর বলিলেন, “টাকা হাতে না পাইলে বর সভাস্থ করা যাইবে না।”

    এই দুর্ঘটনায় অন্তঃপুরে একটা কান্না পড়িয়া গেল। এই গুরুতর বিপদের যে মূল কারণ সে চেলি পরিয়া, গহনা পরিয়া, কপালে চন্দন লেপিয়া, চুপ করিয়া বসিয়া আছে। ভাবী শ্বশুরকুলের প্রতি যে তাহার খুব একটা ভক্তি কিংবা অনুরাগ জন্মিতেছে, তাহা বলা যায় না।ইতিমধ্যে একটা সুবিধা হইল। বর সহসা তাহার পিতৃদেবের অবাধ্য হইয়া উঠিল। সে বাপকে বলিয়া বসিল, “কেনাবেচা-দরদামের কথা আমি বুঝি না, বিবাহ করিতে আসিয়াছি বিবাহ করিয়া যাইব।”বাপ যাহাকে দেখিল তাহাকেই বলিল, “দেখেছেন মহাশয়, আজকালকার ছেলেদের ব্যবহার।” দুই-একজন প্রবীণ লোক ছিল, তাহারা বলিল, “শাস্ত্রশিক্ষা নীতিশিক্ষা একেবারে নাই, কাজেই।”বর্তমান শিক্ষার বিষময় ফল নিজের সন্তানের মধ্যে প্রত্যক্ষ করিয়া রায়বাহাদুর হতোদ্যম হইয়া বসিয়া রহিলেন। বিবাহ একপ্রকার বিষণ্ন নিরানন্দ ভাবে সম্পন্ন হইয়া গেল।

    শ্বশুরবাড়ি যাইবার সময় নিরুপমাকে বুকে টানিয়া লইয়া বাপ আর চোখের জল রাখিতে পারিলেন না। নিরু জিজ্ঞাসা করিল, “তারা কি আর আমাকে আসতে দেবে না, বাবা।” রামসুন্দর বলিলেন, “কেন আসতে দেবে না, মা। আমি তোমাকে নিয়ে আসব।”

    রামসুন্দর প্রায়ই মেয়েকে দেখিতে যান কিন্তু বেহাইবাড়িতে তাঁর কোনো প্রতিপত্তি নাই। চাকরগুলো পর্যন্ত তাঁহাকে নিচু নজরে দেখে। অন্তঃপুরের বাহিরে একটা স্বতন্ত্র ঘরে পাঁচ মিনিটের জন্য কোনোদিন-বা মেয়েকে দেখিতে পান, কোনোদিন-বা দেখিতে পাননা।কুটুম্বগৃহে এমন করিয়া অপমান তো সহা যায় না। রামসুন্দর স্থির করিলেন যেমন করিয়া হউক টাকাটা শোধ করিয়া দিতে হইবে।কিন্তু যে ঋণভার কাঁধে চাপিয়াছে, তাহারই ভার সামলানো দুঃসাধ্য। খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানি পড়িয়াছে; এবং পাওনাদারদের দৃষ্টিপথ এড়াইবার জন্য সর্বদাই নানারূপ হীন কৌশল অবলম্বন করিতে হইতেছে।

    এ দিকে শ্বশুরবাড়ি উঠিতে বসিতে মেয়েকে খোঁটা লাগাইতেছে। পিতৃগৃহের নিন্দা শুনিয়া ঘরে দ্বার দিয়া অশ্রুবিসর্জন তাহার নিত্যক্রিয়ার মধ্যে দাঁড়াইয়াছে।বিশেষত শাশুড়ির আক্রোশ আর কিছুতেই মেটে না। যদি কেহ বলে, “আহা, কী শ্রী। বউয়ের মুখখানি দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়।” শাশুড়ি ঝংকার দিয়া উঠিয়া বলে, “শ্রী তো ভারি। যেমন ঘরের মেয়ে তেমনি শ্রী।”

    এমন-কি, বউয়ের খাওয়াপরারও যত্ন হয় না। যদি কোনো দয়াপরতন্ত্র প্রতিবেশিনী কোনো ত্রুটির উল্লেখ করে, শাশুড়ি বলে, “ঐ ঢের হয়েছে।” অর্থাৎ বাপ যদি পুরা দাম দিত তো মেয়ে পুরা যত্ন পাইত। সকলেই এমন ভাব দেখায় যেন বধূর এখানে কোনো অধিকার নাই, ফাঁকি দিয়া প্রবেশ করিয়াছে।বোধ হয় কন্যার এই-সকল অনাদর এবং অপমানের কথা বাপের কানে গিয়া থাকিবে। তাই রামসুন্দর অবশেষে বসতবাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

    কিন্তু ছেলেদের যে গৃহহীন করিতে বসিয়াছেন সে কথা তাহাদের নিকট হইতে গোপেনে রাখিলেন। স্থির করিয়াছিলেন, বাড়ি বিক্রয় করিয়া সেই বাড়িই ভাড়া লইয়া বাস করিবেন; এমন কৌশলে চলিবেন যে, তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে এ কথা ছেলেরা জানিতে পারিবে না।কিন্তু ছেলেরা জানিতে পারিল। সকলে আসিয়া কাঁদিয়া পড়িল। বিশেষত বড়ো তিনটি ছেলে বিবাহিত এবং তাহাদের কাহারো-বা সন্তান আছে। তাহাদের আপত্তি অত্যন্ত গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল, বাড়ি বিক্রয় স্থগিত হইল।তখন রামসুন্দর নানাস্থান হইতে বিস্তর সুদে অল্প অল্প করিয়া টাকা ধার করিতে লাগিলেন। এমন হইল যে, সংসারের খরচ আর চলে না।

    নিরু বাপের মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিল। বৃদ্ধের পক্ককেশে শুষ্কমুখে এবং সদাসংকুচিত ভাবে দৈন্য এবং দুশ্চিন্তা প্রকাশ হইয়া পড়িল। মেয়ের কাছে যখন বাপ অপরাধী তখন সে অপরাধের অনুতাপ কি আর গোপন রাখা যায়। রামসুন্দর যখন বেহাইবাড়ির অনুমতিক্রমে ক্ষণকালের জন্য কন্যার সাক্ষাৎলাভ করিতেন তখন বাপের বুক যে কেমন করিয়া ফাটে, তাহা তাঁহার হাসি দেখিলেই টের পাওয়া যাইত।

    সেই ব্যথিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দিবার উদ্দেশে দিনকতক বাপের বাড়ি যাইবার জন্য নিরু নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছে। বাপের ম্লান মুখ দেখিয়া সে আর দূরে থাকিতে পারে না। একদিন রামসুন্দরকে কহিল, “বাবা, আমাকে একবার বাড়ি লইয়া যাও।” রামসুন্দর বলিলেন, “আচ্ছা।”

    কিন্তু তাঁহার কোনো জোর নাই– নিজের কন্যার উপরে পিতার যে স্বাভাবিক অধিকার আছে, তাহা যেন পণের টাকার পরিবর্তে বন্ধক রাখিতে হইয়াছে। এমন-কি, কন্যার দর্শন, সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময়বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখ থাকে না।

    কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাকে না আনিয়া কেমন করিয়া থাকে। তাই, বেহাইয়ের নিকট সে- সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে রামসুন্দর কত হীনতা, কত অপমান, কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো।

    নোট-কখানি রুমালে জড়াইয়া চাদরে বাঁধিয়া রামসুন্দর বেহাইয়ের নিকট গিয়া বসিলেন। প্রথমে হাস্যমুখে পাড়ার খবর পাড়িলেন। হরেকৃষ্ণের বাড়িতে একটা মস্ত চুরি হইয়া গিয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত বিবরণ বলিলেন। নবীনমাধব ও রাধামাধব দুই ভাইয়ের তুলনা করিয়া বিদ্যাবুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে রাধামাধবের সুখ্যাতি এবং নবীনমাধবের নিন্দা করিলেন; শহরে একটা নূতন ব্যামো আসিয়াছে, সে- সম্বন্ধে অনেক আজগুবি আলোচনা করিলেন; অবশেষে হুঁকাটি নামাইয়া রাখিয়া কথায় কথায় বলিলেন, “হাঁ হাঁ বেহাই, সেই টাকাটা বাকি আছে বটে। রোজই মনে করি, যাচ্ছি অমনি হাতে করে কিছু নিয়ে যাই কিন্তু সময়কালে মনে থাকে না। আর ভাই, বুড়ো হয়ে পড়েছি।” এমনি এক দীর্ঘ ভূমিকা করিয়া পঞ্জরের তিনখানি অস্থির মতো সেই তিনখানি নোট যেন অতি সহজে অতি অবহেলে বাহির করিলেন। সবেমাত্র তিন হাজার টাকার নোট দেখিয়া রায়বাহাদুর অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন।বলিলেন, “থাক্‌ বেহাই, ওতে আমার কাজ নেই।” একটা প্রচলিত বাংলা প্রবাদের উল্লেখ করিয়া বলিলেন, সামান্য কারণে হাতে দুর্গন্ধ করিতে তিনি চান না।

    এই ঘটনার পরে মেয়েকে বাড়ি আনিবার প্রস্তাব কাহারো মুখে আসে না– কেবল রামসুন্দর ভাবিলেন,”সে-সকল কুটুম্বিতার সংকোচ আমাকে আর শোভা পায় না।” মর্মাহতভাবে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে মৃদুস্বরে কথাটা পাড়িলেন। রায়বাহাদুর কোনো কারণমাত্র উল্লেখ না করিয়া বলিলেন, “সে এখন হচ্ছে না।” এই বলিয়া কর্মোপলক্ষে স্থানান্তরে চলিয়া গেলেন।রামসুন্দর মেয়ের কাছে মুখ না দেখাইয়া কম্পিতহস্তে কয়েকখানি নোট চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।

    বহুদিন গেল। নিরুপমা লোকের উপর লোক পাঠায় কিন্তু বাপের দেখা পায় না। অবশেষে অভিমান করিয়া লোক পাঠানো বন্ধ করিল– তখন রামসুন্দরের মনে বড়ো আঘাত লাগিল, কিন্তু তবু গেলেন না।আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, “এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি”– খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন।

    পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল,”দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?” বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই।

    রামসুন্দর তাহা জানিতেন, এবং সে- সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসমান্য অলংকারে অনুগ্রহপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, এ কথা  স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর-কোনো ফল হয় নাই।

    দৈন্যপীড়িত গৃহের ক্রন্দনধ্বনি কানে লইয়া বৃদ্ধ তাঁহার বেহাইবাড়িতে প্রবেশ করিলেন। আজ তাঁহার সে সংকোচভাব নাই; দ্বাররক্ষী এবং ভৃত্যদের মুখের প্রতি সে চকিত সলজ্জ দৃষ্টিপাত দূর হইয়া গিয়াছে, যেন আপনার গৃহে প্রবেশ করিলেন। শুনিলেন, রায়বাহাদুর ঘরে নাই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইবে। মনের উচ্ছ্বাস সংবরণ করিতে না পারিয়া রামসুন্দর কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। আনন্দে দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বাপও কাঁদে মেয়েও কাঁদে; দুইজনে কেহ আর কথা কহিতে পারে না। এমন করিয়া কিছুক্ষণ গেল। তার পরে রামসুন্দর কহিলেন,”এবার তোকে নিয়ে যাচ্ছি, মা। আর কোনো গোল নাই।”

    এমন সময় রামসুন্দরের জ্যেষ্ঠপুত্র হরমোহন তার দুটি ছোটো ছেলে সঙ্গে লইয়া সহসা ঘরে প্রবেশ করিলেন। পিতাকে বলিলেন, “বাবা, আমাদের তবে এবার পথে ভাসালে?”রামসুন্দর সহসা অগ্নিমূর্তি হইয়া বলিলেন, “তোদের জন্য কি আমি নরকগামী হব। আমাকে তোরা আমার সত্য পালন করতে দিবি নে?” রামসুন্দর বাড়ি বিক্রয় করিয়া বসিয়া আছেন; ছেলেরা কিছুতে না জানিতে পায়, তাহার অনেক ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, কিন্তু তবু তাহারা জানিয়াছে দেখিয়া তাহাদের প্রতি হঠাৎ অত্যন্ত রুষ্ট ও বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।

    তাঁহার নাতি তাঁহার দুই হাঁটু সবলে জড়াইয়া ধরিয়া মুখ তুলিয়া কহিল, “দাদু আমাকে গাড়ি কিনে দিলে না?”নতশির রামসুন্দরের কাছে বালক কোনো উত্তর না পাইয়া নিরুর কাছে গিয়া বলিল, “পিসিমা, আমাকে একখানা গাড়ি কিনে দেবে?”নিরুপমা সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া কহিল, “বাবা, তুমি যদি আর এক পয়সা আমার শ্বশুরকে দাও, তা হলে আর তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে না, এই তোমার গা ছুঁয়ে বললুম।”

    রামসুন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান আর তোরও অপমান।”নিরু কহিল, “টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না। তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না।”রামসুন্দর কহিলেন, “তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা।”নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলো। তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ো না।”রামসুন্দর কম্পিত হস্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাঁধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন।

    কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে কথা গোপন রহিল না। কোনো স্বভাবকৌতূহলী দ্বারলগ্নকর্ণদাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল। শুনিয়া তাঁহার আর আক্রোশের সীমা রহিল না।নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল। এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে; এবং পাছে সংসর্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয়, এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে।

    এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত। কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই। আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না। সে-যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল। কিন্তু এরূপ ভাবটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না। যদি আহারের প্রতি বধূর কোনো অবহেলা দেখিতেন, তবে শাশুড়ি বলিতেন, “নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা। গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না।” কখনো-বা বলিতেন, “দেখো-না একবার, ছিরি হচ্ছে দেখো-না, দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে।”

    রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন, “ওঁর সমস্ত ন্যাকামি।” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল, “বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা।” শাশুড়ি বলিলেন, “কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছল।”

    কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না– যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল, সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল, এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল।

    বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্রতিমাবিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরিদের যেমন লোকবিখ্যাত প্রতিপত্তি আছে, বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রটিয়া গেল– এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনো দেখে নাই। এমন ঘটা করিয়া শ্রাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব এবং শুনা যায়, ইহাতে তাঁহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল।

    রামসুন্দরকে সান্ত্বনা দিবার সময় তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল।

    এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসিল, “আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি, অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে।” রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন, “বাবা তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে।”

    এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়।

    See less
  1. পোস্টমাস্টার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্টআপিস স্থাপন করাইয়াছে। আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আRead more

    পোস্টমাস্টার (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

    প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্টআপিস স্থাপন করাইয়াছে।

    আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহার ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে।

    বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না। অথচ হাতে কাজ অধিক নাই। কখনো-কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড়ো সুখে কাটিয়া যায়– কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।

    পোস্টমাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন। বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না।

    সন্ধ্যার সময় যখন গ্রামের গোয়ালঘর হইতে ধূম কুণ্ডলায়িত হইয়া উঠিত, ঝোপে ঝোপে ঝিল্লি ডাকিত, দূরে গ্রামের নেশাখোর বাউলের দল খোল-করতাল বাজাইয়া উচ্চৈঃস্বরে গান জুড়িয়া দিত– যখন অন্ধকার দাওয়ায় একলা বসিয়া গাছের কম্পন দেখিলে কবিহৃদয়েও ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত তখন ঘরের কোণে একটি ক্ষীণশিখা প্রদীপ জ্বালিয়া পোস্টমাস্টার ডাকিতেন “রতন”। রতন দ্বারে বসিয়া এই ডাকের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিত কিন্তু এক ডাকেই ঘরে আসিত না– বলিত, “কী গা বাবু, কেন ডাকছ।”

    পোস্টমাস্টার। তুই কী করছিস।

    রতন। এখনই চুলো ধরাতে যেতে হবে– হেঁশেলের–

    পোস্টমাস্টার। তোর হেঁশেলের কাজ পরে হবে এখন– একবার তামাকটা সেজে দে তো।

    অনতিবিলম্বে দুটি গাল ফুলাইয়া কলিকায় ফুঁ দিতে দিতে রতনের প্রবেশ। হাত হইতে কলিকাটা লইয়া পোস্টমাস্টার ফস্‌ করিয়া জিজ্ঞাসা করেন, “আচ্ছা রতন, তোর মাকে মনে পড়ে?” সে অনেক কথা; কতক মনে পড়ে, কতক মনে পড়ে না। মায়ের চেয়ে বাপ তাহাকে বেশি ভালোবাসিত, বাপকে অল্প অল্প মনে আছে। পরিশ্রম করিয়া বাপ সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরিয়া আসিত, তাহারই মধ্যে দৈবাৎ দুটি-একটি সন্ধ্যা তাহার মনে পরিষ্কার ছবির মতো অঙ্কিত আছে। এই কথা হইতে হইতে ক্রমে রতন পোস্টমাস্টারের পায়ের কাছে মাটির উপর বসিয়া পড়িত। মনে পড়িত, তাহার একটি ছোটোভাই ছিল– বহু পূর্বেকার বর্ষার দিনে একদিন একটা ডোবার ধারে দুইজনে মিলিয়া গাছের ভাঙা ডালকে ছিপ করিয়া মিছামিছি মাছধরা খেলা করিয়াছিল– অনেক গুরুতর ঘটনার চেয়ে সেই কথাটাই তাহার মনে বেশি উদয় হইত। এইরূপ কথাপ্রসঙ্গে মাঝে মাঝে বেশি রাত হইয়া যাইত, তখন আলস্যক্রমে পোস্টমাস্টারের আর রাঁধিতে ইচ্ছা করিত না। সকালের বাসী ব্যঞ্জন থাকিত এবং রতন তাড়াতাড়ি উনুন ধরাইয়া খানকয়েক রুটি সেঁকিয়া আনিত– তাহাতেই উভয়ের রাত্রের আহার চলিয়া যাইত।

    এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সেই বৃহৎ আটচালার কোণে আপিসের কাঠের চৌকির উপর বসিয়া পোস্টমাস্টারও নিজের ঘরের কথা পাড়িতেন– ছোটোভাই, মা এবং দিদির কথা, প্রবাসে একলা ঘরে বসিয়া যাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিত তাহাদের কথা। যে-সকল কথা সর্বদাই মনে উদয় হয় অথচ নীলকুঠির গোমস্তাদের কাছে যাহা কোনোমতেই উত্থাপন করা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিতা ক্ষুদ্র বালিকাকে বলিয়া যাইতেন, কিছুমাত্র অসংগত মনে হইত না। অবশেষে এমন হইল, বালিকা কথোপকথনকালে তাঁহার ঘরের লোকদিগকে মা, দিদি, দাদা বলিয়া চিরপরিচিতের ন্যায় উল্লেখ করিত। এমন-কি, তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়পটে বালিকা তাঁহাদের কাল্পনিক মূর্তিও চিত্রিত করিয়া লইয়াছিল।

    একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল, রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উত্থিত হইতেছিল, মনে হইতেছিল যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিশ্বাস গায়ের উপরে আসিয়া লাগিতেছে, এবং কোথাকার এক নাছোড়বান্দা পাখি তাহার একটা একটানা সুরের নালিশ সমস্ত দুপুরবেলা প্রকৃতির দরবারে অত্যন্ত করুণস্বরে বার বার আবৃত্তি করিতেছিল। পোস্টমাস্টারের হাতে কাজ ছিল না– সেদিনকার বৃষ্টিধৌত মসৃণ চিক্কণ তরুপল্লবের হিল্লোল এবং পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তূপাকার মেঘস্তর বাস্তবিকই দেখিবার বিষয় ছিল; পোস্টমাস্টার তাহা দেখিতেছিলেন এবং ভাবিতেছিলেন, এই সময়ে কাছে একটি-কেহ নিতান্ত আপনার লোক থাকিত– হৃদয়ের সহিত একান্তসংলগ্ন একটি স্নেহপুত্তলি মানবমূর্তি। ক্রমে মনে হইতে লাগিল, সেই পাখি ঐ কথাই বার বার বলিতেছে এবং এই জনহীন তরুচ্ছায়ানিমগ্ন মধ্যাহ্নের পল্লবমর্মরের অর্থও কতকটা ঐরূপ। কেহ বিশ্বাস করে না, এবং জানিতেও পায় না, কিন্তু ছোটো পল্লীর সামান্য বেতনের সাব-পোস্টামাস্টারের মনে গভীর নিস্তব্ধ মধ্যাহ্ন দীর্ঘ ছুটির দিনে এইরূপ একটা ভাবের উদয় হইয়া থাকে।

    পোস্টামাস্টার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিলেন, “রতন”। রতন তখন পেয়ারাতলায় পা ছড়াইয়া দিয়া কাঁচা পেয়ারা খাইতেছিল; প্রভুর কন্ঠস্বর শুনিয়া অবিলম্বে ছুটিয়া আসিল– হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “দাদাবাবু, ডাকছ?” পোস্টমাস্টার বলিলেন, “তোকে আমি একটু একটু করে পড়তে শেখাব।” বলিয়া সমস্ত দুপুরবেলা তাহাকে লইয়া “স্বরে অ” “স্বরে আ” করিলেন। এবং এইরূপে অল্পদিনেই যুক্ত-অক্ষর উত্তীর্ণ হইলেন।

    শ্রাবণমাসে বর্ষণের আর অন্ত নাই। খাল বিল নালা জলে ভরিয়া উঠিল। অহর্নিশি ভেকের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ। গ্রামের রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ– নৌকায় করিয়া হাটে যাইতে হয়।

    একদিন প্রাতঃকাল হইতে খুব বাদলা করিয়াছে। পোস্টমাস্টারের ছাত্রীটি অনেকক্ষণ দ্বারের কাছে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল, কিন্তু অন্যদিনের মতো যথাসাধ্য নিয়মিত ডাক শুনিতে না পাইয়া আপনি খুঙ্গিপুঁথি লইয়া ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল, পোস্টমাস্টার তাঁহার খাটিয়ার উপর শুইয়া আছেন– বিশ্রাম করিতেছেন মনে করিয়া অতি নিঃশব্দে পুনশ্চ ঘর হইতে বাহিরে যাইবার উপক্রম করিল। সহসা শুনিল “রতন”। তাড়াতাড়ি ফিরিয়া গিয়া বলিল, “দাদাবাবু, ঘুমোচ্ছিলে?” পোস্টমাস্টার কাতরস্বরে বলিলেন, “শরীরটা ভালো বোধ হচ্ছে না– দেখ্‌ তো আমার কপালে হাত দিয়ে।”

    এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারীরূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন, এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে। এবং এস্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”

    বহুদিন পরে পোস্টমাস্টার ক্ষীণ শরীরে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিলেন– মনে স্থির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনোমতে বদলি হইতে হইবে। স্থানীয় অস্বাস্থ্যের উল্লেখ করিয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় কর্তৃপক্ষদের নিকট বদলি হইবার জন্য দরখাস্ত  করিলেন।

    রোগসেবা হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া রতন দ্বারের বাহিরে আবার তাহার স্বস্থান অধিকার করিল। কিন্তু পূর্ববৎ আর তাহাকে ডাক পড়ে না; মাঝে মাঝে উঁকি মারিয়া দেখে, পোস্টমাস্টার অত্যন্ত অন্যমনস্কভাবে চৌকিতে বসিয়া অথবা খাটিয়ায় শুইয়া আছেন। রতন যখন আহ্বান প্রত্যাশা করিয়া বসিয়া আছে, তিনি তখন অধীরচিত্তে তাঁহার দরখাস্তের উত্তর প্রতীক্ষা করিতেছেন। বালিকা দ্বারের বাহিরে বসিয়া সহস্রবার করিয়া তাহার পুরানো পড়া পড়িল। পাছে যেদিন সহসা ডাক পড়িবে সেদিন তাহার যুক্ত-অক্ষর সমস্ত গোলমাল হইয়া যায়, এই তাহার একটা আশঙ্কা ছিল। অবশেষে সপ্তাহখানেক পরে একদিন সন্ধ্যাবেলায় ডাক পড়িল। উদ্‌বেলিতহৃদয়ে রতন গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “দাদাবাবু, আমাকে ডাকছিলে?”

    পোস্টমাস্টার বলিলেন, “রতন, কালই আমি যাচ্ছি।”

    রতন।  কোথায় যাচ্ছ, দাদাবাবু।

    পোস্টমাস্টার।  বাড়ি যাচ্ছি।

    রতন।  আবার কবে আসবে।

    পোস্টমাস্টার।  আর আসব না।

    রতন আর-কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিল না। পোস্টমাস্টার আপনিই তাহাকে বলিলেন, তিনি বদলির জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন, দরখাস্ত নামঞ্জুর হইয়াছে; তাই তিনি কাজে জবাব দিয়া বাড়ি যাইতেছেন। অনেকক্ষণ আর কেহ কোনো কথা কহিল না। মিটমিট করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপ টপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।

    কিছুক্ষণ পরে রতন আস্তে আস্তে উঠিয়া রান্নঘরে রুটি গড়িতে গেল। অন্যদিনের মতো তেমন চটপট হইল না। বোধ করি মধ্যে মধ্যে মাথায় অনেক ভাবনা উদয় হইয়াছিল। পোস্টমাস্টারের আহার সমাপ্ত হইলে পর বালিকা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?”

    পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, “সে কী করে হবে।” ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বুঝানো আবশ্যক বোধ করিলেন না।

    সমস্ত রাত্রি স্বপ্নে এবং জাগরণে বালিকার কানে পোস্টমাস্টারের হাস্যধ্বনির কন্ঠস্বর বাজিতে লাগিল– “সে কী করে হবে’।

    ভোরে উঠিয়া পোস্টমাস্টার দেখিলেন, তাঁহার স্নানের জল ঠিক আছে; কলিকাতার অভ্যাস অনুসারে তিনি তোলা জলে স্নান করিতেন। কখন তিনি যাত্রা করিবেন সে কথা বালিকা কী কারণে জিজ্ঞাসা করিতে পারে নাই; পাছে প্রাতঃকালে আবশ্যক হয় এইজন্য রতন তত রাত্রে নদী হইতে তাঁহার স্নানের জল তুলিয়া আনিয়াছিল। স্নান সমাপন হইলে রতনের ডাক পড়িল। রতন নিঃশব্দে গৃহে প্রবেশ করিল এবং আদেশপ্রতীক্ষায় একবার নীরবে প্রভুর মুখের দিকে চাহিল। প্রভু কহিলেন, “রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবেন তাঁকে বলে দিয়ে যাব তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন, আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।” এই কথাগুলি যে অত্যন্ত স্নেহগর্ভ এবং দয়ার্দ্র হৃদয় হইতে উত্থিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু নারীহৃদয় কে বুঝিবে। রতন অনেকদিন প্রভুর অনেক তিরস্কার নীরবে সহ্য করিয়াছে কিন্তু এই নরম কথা সহিতে পারিল না। একেবারে উচ্ছ্বসিতহৃদয়ে কাঁদিয়া উঠিয়া কহিল, “না না, তোমার কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাই নে।”

    পোস্টমাস্টার রতনের এরূপ ব্যবহার কখনো দেখেন নাই, তাই অবাক হইয়া রহিলেন।

    নূতন পোস্টমাস্টার আসিল। তাহাকে সমস্ত চার্জ বুঝাইয়া দিয়া পুরাতন পোস্টমাস্টার গমনোন্মুখ হইলেন। যাইবার সময় রতনকে ডাকিয়া বলিলেন, “রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিনকয়েক চলবে।”

    কিছু পথখরচা বাদে তাঁহার বেতনের যত টাকা পাইয়াছিলেন পকেট হইতে বাহির করিলেন। তখন রতন ধুলায় পড়িয়া তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্যে কাউকে কিছু ভাবতে হবে না”– বলিয়া একদৌড়ে সেখান হইতে পলাইয়া গেল।

    ভূতপূর্ব পোস্টমাস্টার নিশ্বাস ফেলিয়া হাতে কার্পেটের ব্যাগ ঝুলাইয়া, কাঁধে ছাতা লইয়া, মুটের মাথায় নীল ও শ্বেত রেখায় চিত্রিত টিনের পেঁটরা তুলিয়া ধীরে ধীরে নৌকাভিমুখে চলিলেন।

    যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন– একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, “ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি”- কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে- এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।

    কিন্তু রতনের মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হইল না। সে সেই পোস্টআপিস গৃহের চারি দিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধ করি তাহার  মনে ক্ষীণ আশা জাগিতেছিল, দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে– সেই বন্ধনে পড়িয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতেছিল না। হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।

    See less
  1. This answer was edited.

    ফসিল সুবোধ ঘোষের একটি শ্রেষ্ট ছোটগল্প।পরে ফসিল নাম দিয়ে তাঁর একটি ছোটগল্প সংকলন বের হয়। সেই সংকলনে যে গল্পগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলি হলো। ফসিল যাযাবর শক থেরাপী অযান্ত্রিক দন্ডমুন্ডু গ্লানিহর সুন্দরম সবলা গোত্রান্তর     ফসিল গল্পের বইটি  PDF ডাউনলোড করতে এই লিংক এ ক্লিক করুন।

    ফসিল সুবোধ ঘোষের একটি শ্রেষ্ট ছোটগল্প।পরে ফসিল নাম দিয়ে তাঁর একটি ছোটগল্প সংকলন বের হয়। সেই সংকলনে যে গল্পগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেগুলি হলো।

    • ফসিল
    • যাযাবর
    • শক থেরাপী
    • অযান্ত্রিক
    • দন্ডমুন্ডু
    • গ্লানিহর
    • সুন্দরম
    • সবলা
    • গোত্রান্তর

     

      ফসিল গল্পের বইটি  PDF ডাউনলোড করতে এই লিংক এ ক্লিক করুন

    See less
  1. স্বামী বিবেকানন্দ ভূমিকা “বীর সন্ন্যাসী বিবেক বাণী ছুটেছে জগৎময়, বাঙ্গালীর ছেলে ব্যাঘ্রে-বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।” কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের গৌরবের কথা বলতে গিয়ে এই কথাগুলি লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক সত্যকে বিবেকানন্দ যে ভাবে জগৎ সভায় উপস্থাপিত করেছিলেন, তার সত্যিRead more

    স্বামী বিবেকানন্দ

    ভূমিকা “বীর সন্ন্যাসী বিবেক বাণী ছুটেছে জগৎময়,

    বাঙ্গালীর ছেলে ব্যাঘ্রে-বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।”

    কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের গৌরবের কথা বলতে গিয়ে এই কথাগুলি লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক সত্যকে বিবেকানন্দ যে ভাবে জগৎ সভায় উপস্থাপিত করেছিলেন, তার সত্যিই তুলনা হয় না। ভারতবর্ষকে তিনি বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

    জন্ম ও পরিচয় : ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি কলকাতার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে বিবেকানন্দের জন্ম হয়। শৈশবে তার নাম ছিল “বীরেশ্বর’ বা ‘বিলে’। তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত সে যুগের একজন বিখ্যাত এটর্নি ছিলেন। মাতা ভুবনেশ্বরীও ছিলেন তেজস্বী মহিলা। প্রথমে গৃহশিক্ষকের কাছে, পরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে, এবং তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি পড়েন। ১৮৮৩ সালে তিনি বি. এ. পাশ করে আইন পড়তে আরম্ভ করেন বটে, কিন্তু হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় পড়াশুনা ছাড়তে তিনি বাধ্য হন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ঈশ্বরমুখী ছিলেন। সংকীর্ণ জাত-পাত তিনি মানতেন না।

    রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্য :- বি. এ. পড়বার সময় তিনি পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসেন। আর এই সংস্পর্শে আসার প্রথম দিনটি থেকেই তিনি রামকৃষ্ণ দেবের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। তাঁর বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এই তরুণ যুবকটিকে দান করে তাকে দীক্ষিত করেন নতুন নতুন মন্ত্রে। রামকৃষ্ণদেব ছিলেন নবযুগের আচার্য। সকল ধর্ম ও মতের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল এবং তিনি তার। সাধনা ও জীবন চর্চার ভিতর দিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন যে “যত মত তত পথ’।তাছাড়া জীব সেবার মধ্য দিয়েই যে ঈশ্বর সেবা হয়, এতে তিনি ছিলেন গভীর বিশ্বাসী।

    ভারত পরিক্রমা : ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ পরিব্রাজক হয়ে তিন বছর ধরে সারা ভারত পরিক্রমা করেন। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে আমেরিকার শিকাগাে শহরে ধর্মমহাসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য হিন্দু ধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে তিনি ভারত থেকে রওয়ানা হলেন। এই মহাসভায় হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে তিনি অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার বহু নর-নারী তার ধর্ম মতে আকৃষ্ট হয়ে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ভগিনী নিবেদিতা একজন।

    মিশন ও আদর্শ :- বিজয়ীর সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে এসে ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ এবং ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বেলুড় মঠ’। মানব সেবা, বেদান্ত দর্শন এবং রামকৃষ্ণের শিক্ষাপ্রচারই ছিল মিশন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। দয়া নয়, দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের সেবার মধ্যদিয়ে তিনি ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ দেখিয়েছিলেন। তার মতে ঈশ্বর আছেন আমাদের সামনে ‘বহুরূপে’ দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের মধ্যে। এদের সেবা করলেই ঈশ্বরকেই লাভ করা যাবে।

    ‘বহুরূপে সম্মুখে তােমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর; |

    জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

    ভারত প্রীতি :- তিনি নিজদেশকে সকলের উপরে স্থান দিতেন। প্রতিটি ভারত বাসীকে তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। দেশকে গড়ে তুলার জন্য তিনি স্বপ্ন দেখতেন, সেই দেশ গড়ার স্বপ্নকে তিনি চেয়েছেন বাস্তবে রূপায়ণ করতে। তার লক্ষ্যছিল সকলের কল্যাণের জন্য এক বৃহৎ অখণ্ড ভারতবর্ষ গড়ে তােলা। তিনিই এদেশ সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসীর ভ্রান্তধারণা দূর করেছিলেন। স্বামীজী দেখতে চেয়েছিলেন এক শক্তিশালী ভারতবর্ষকে।

    মানবতাবাদী বৈদান্তিকঃ স্বামী বিবেকানন্দ বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হলেও আধুনিক মানবতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুধর্মের এই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থটিকে গ্রহণ করেছিলেন। বেদান্তের এই নবভাস্যকার বলেন – ‘জগতে জ্ঞানালোেক বিস্তার কর; আলােক-অলােক লইয়া আইস। প্রত্যেকে যেন জ্ঞানের আলাে পায়, যতদিন না সকলেই ভগবান লাভ করে, ততদিন যেন তােমাদের কাজ শেষ না হয়। জগজ্জননীর কাছে তিনি মনুষ্যত্ব প্রার্থনা। করে বলেছেন, “হে জগদম্বে আমায় মনুষ্যত্ব দাও, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দুর কর, অমিয় মানুষ কর।’

    সাহিত্য কৃতি : শুধু কর্মের জগতেই নয়, চিন্তা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকান্দ মানবতার বাণী প্রচার করেন গেছেন। তাঁর রচিত প্রধান গ্রন্থগুলি— ‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। বাংলাভাষায় তাঁর পত্রগুচ্ছে কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক আলােচনাও করেছেন। বাংলা চলিত গদ্যরীতির তিনি অন্যতম পথিকৃৎ, কথ্য শব্দ প্রয়োগেও দুঃসাহসী পথ প্রদর্শক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের, শিক্ষিত ভারতবর্ষের, সংস্কারহীন ভারতবর্ষের। ভারতবর্ষই ছিল তার শৈশবের শিশুশয্যা, যৌবনের উপবন আর বাধকের বারাণসী। তিনি বুকে হাত রেখে বলতে শিখিয়েছেন, “ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষ আমার ভাই, আমার রক্ত। ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ, ভারতের দীনতা আমার অপমান।”

    উপসংহার : অত্যাধিক পরিশ্রম আর নিরলস কর্মসাধনায় এই কর্মী সন্ন্যাসীর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। অবশেষে ১৯০২ সালের ৪ জুলাই মাত্র ৩৯ বৎসর। বয়সে এই বীর সন্ন্যাসী বেলুড় মঠে চিরনিদ্রায় অভিভূত হন। স্বামীজীর জন্ম দিবস সারা ভারতবর্ষে ‘জাতীয় যুব দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। কিন্তু স্বামীজীর সেই ত্যাগ, সেই জীব প্রেম, সেই উদ্যম বর্তমান ভারতবর্ষে কোথায় ? অন্ধকার থেকে আলাের দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে,অসৎ থেকে সৎ এর পথে আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন যে মহামানব, সেই বিবেকানন্দই ভারতবর্ষের প্রকৃত বাতিঘর।

    See less
  1. স্বামী বিবেকানন্দ ভূমিকা “বীর সন্ন্যাসী বিবেক বাণী ছুটেছে জগৎময়, বাঙ্গালীর ছেলে ব্যাঘ্রে-বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।” কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের গৌরবের কথা বলতে গিয়ে এই কথাগুলি লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক সত্যকে বিবেকানন্দ যে ভাবে জগৎ সভায় উপস্থাপিত করেছিলেন, তার সত্যিRead more

    স্বামী বিবেকানন্দ

    ভূমিকা “বীর সন্ন্যাসী বিবেক বাণী ছুটেছে জগৎময়,

    বাঙ্গালীর ছেলে ব্যাঘ্রে-বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।”

    কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের গৌরবের কথা বলতে গিয়ে এই কথাগুলি লিখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে। ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক সত্যকে বিবেকানন্দ যে ভাবে জগৎ সভায় উপস্থাপিত করেছিলেন, তার সত্যিই তুলনা হয় না। ভারতবর্ষকে তিনি বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

    জন্ম ও পরিচয় : ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি কলকাতার বিখ্যাত দত্ত পরিবারে বিবেকানন্দের জন্ম হয়। শৈশবে তার নাম ছিল “বীরেশ্বর’ বা ‘বিলে’। তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত সে যুগের একজন বিখ্যাত এটর্নি ছিলেন। মাতা ভুবনেশ্বরীও ছিলেন তেজস্বী মহিলা। প্রথমে গৃহশিক্ষকের কাছে, পরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে, এবং তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি পড়েন। ১৮৮৩ সালে তিনি বি. এ. পাশ করে আইন পড়তে আরম্ভ করেন বটে, কিন্তু হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় পড়াশুনা ছাড়তে তিনি বাধ্য হন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ঈশ্বরমুখী ছিলেন। সংকীর্ণ জাত-পাত তিনি মানতেন না।

    রামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্য :- বি. এ. পড়বার সময় তিনি পরমপুরুষ রামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসেন। আর এই সংস্পর্শে আসার প্রথম দিনটি থেকেই তিনি রামকৃষ্ণ দেবের প্রতি এক গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। তাঁর বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এই তরুণ যুবকটিকে দান করে তাকে দীক্ষিত করেন নতুন নতুন মন্ত্রে। রামকৃষ্ণদেব ছিলেন নবযুগের আচার্য। সকল ধর্ম ও মতের প্রতি তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল এবং তিনি তার। সাধনা ও জীবন চর্চার ভিতর দিয়ে আবিষ্কার করেছিলেন যে “যত মত তত পথ’।তাছাড়া জীব সেবার মধ্য দিয়েই যে ঈশ্বর সেবা হয়, এতে তিনি ছিলেন গভীর বিশ্বাসী।

    ভারত পরিক্রমা : ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ পরিব্রাজক হয়ে তিন বছর ধরে সারা ভারত পরিক্রমা করেন। ১৮৯৩ খৃষ্টাব্দে আমেরিকার শিকাগাে শহরে ধর্মমহাসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য হিন্দু ধর্মের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে তিনি ভারত থেকে রওয়ানা হলেন। এই মহাসভায় হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে তিনি অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকার বহু নর-নারী তার ধর্ম মতে আকৃষ্ট হয়ে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ভগিনী নিবেদিতা একজন।

    মিশন ও আদর্শ :- বিজয়ীর সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে এসে ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ এবং ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘বেলুড় মঠ’। মানব সেবা, বেদান্ত দর্শন এবং রামকৃষ্ণের শিক্ষাপ্রচারই ছিল মিশন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। দয়া নয়, দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের সেবার মধ্যদিয়ে তিনি ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ দেখিয়েছিলেন। তার মতে ঈশ্বর আছেন আমাদের সামনে ‘বহুরূপে’ দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের মধ্যে। এদের সেবা করলেই ঈশ্বরকেই লাভ করা যাবে।

    ‘বহুরূপে সম্মুখে তােমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর; |

    জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

    ভারত প্রীতি :- তিনি নিজদেশকে সকলের উপরে স্থান দিতেন। প্রতিটি ভারত বাসীকে তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। দেশকে গড়ে তুলার জন্য তিনি স্বপ্ন দেখতেন, সেই দেশ গড়ার স্বপ্নকে তিনি চেয়েছেন বাস্তবে রূপায়ণ করতে। তার লক্ষ্যছিল সকলের কল্যাণের জন্য এক বৃহৎ অখণ্ড ভারতবর্ষ গড়ে তােলা। তিনিই এদেশ সম্পর্কে পাশ্চাত্যবাসীর ভ্রান্তধারণা দূর করেছিলেন। স্বামীজী দেখতে চেয়েছিলেন এক শক্তিশালী ভারতবর্ষকে।

    মানবতাবাদী বৈদান্তিকঃ স্বামী বিবেকানন্দ বৈদান্তিক সন্ন্যাসী হলেও আধুনিক মানবতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুধর্মের এই শ্রেষ্ঠ গ্রন্থটিকে গ্রহণ করেছিলেন। বেদান্তের এই নবভাস্যকার বলেন – ‘জগতে জ্ঞানালোেক বিস্তার কর; আলােক-অলােক লইয়া আইস। প্রত্যেকে যেন জ্ঞানের আলাে পায়, যতদিন না সকলেই ভগবান লাভ করে, ততদিন যেন তােমাদের কাজ শেষ না হয়। জগজ্জননীর কাছে তিনি মনুষ্যত্ব প্রার্থনা। করে বলেছেন, “হে জগদম্বে আমায় মনুষ্যত্ব দাও, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দুর কর, অমিয় মানুষ কর।’

    সাহিত্য কৃতি : শুধু কর্মের জগতেই নয়, চিন্তা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকান্দ মানবতার বাণী প্রচার করেন গেছেন। তাঁর রচিত প্রধান গ্রন্থগুলি— ‘পরিব্রাজক’, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। বাংলাভাষায় তাঁর পত্রগুচ্ছে কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক আলােচনাও করেছেন। বাংলা চলিত গদ্যরীতির তিনি অন্যতম পথিকৃৎ, কথ্য শব্দ প্রয়োগেও দুঃসাহসী পথ প্রদর্শক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের, শিক্ষিত ভারতবর্ষের, সংস্কারহীন ভারতবর্ষের। ভারতবর্ষই ছিল তার শৈশবের শিশুশয্যা, যৌবনের উপবন আর বাধকের বারাণসী। তিনি বুকে হাত রেখে বলতে শিখিয়েছেন, “ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষ আমার ভাই, আমার রক্ত। ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ, ভারতের দীনতা আমার অপমান।”

    উপসংহার : অত্যাধিক পরিশ্রম আর নিরলস কর্মসাধনায় এই কর্মী সন্ন্যাসীর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। অবশেষে ১৯০২ সালের ৪ জুলাই মাত্র ৩৯ বৎসর। বয়সে এই বীর সন্ন্যাসী বেলুড় মঠে চিরনিদ্রায় অভিভূত হন। স্বামীজীর জন্ম দিবস সারা ভারতবর্ষে ‘জাতীয় যুব দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। কিন্তু স্বামীজীর সেই ত্যাগ, সেই জীব প্রেম, সেই উদ্যম বর্তমান ভারতবর্ষে কোথায় ? অন্ধকার থেকে আলাের দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে,অসৎ থেকে সৎ এর পথে আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন যে মহামানব, সেই বিবেকানন্দই ভারতবর্ষের প্রকৃত বাতিঘর।

    See less
  1. ভগিনী নিবেদিতা ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙRead more

    ভগিনী নিবেদিতা

    ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রকৃত ভগিনীর আসনে চির প্রতিষ্ঠাতা।

    জন্ম ও পরিচয় : ভগিনী নিবেদিতার জন্ম উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের ডানগ্যানন শহরে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে। তার পূর্ব নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নােবেল। পিতা স্যামুয়েল রিচমও নােবেলের অকাল মৃত্যু সমগ্র পরিবারকে ঠেলে দিয়েছিল দারিদ্র্যের মধ্যে। মার্গারেটের জননী দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাতামহ হ্যামিলটনের সংসারে। স্কুল ও কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে মার্গারেট রেক্সহ্যাম শহরে শিক্ষিকার কাজ, করতে লাগলেন। এই সময় তিনি আকৃষ্ট হলেন ওয়েলসবাসী এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের প্রতি। সেই ইঞ্জিনিয়ারের অকাল মৃত্যুর পর মার্গারেট রেক্সহামের চাকুরি ছেড়ে চলে এলেন চেস্টারে। শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে করতে লাগলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা।

    স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্য লাভ : ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিকাগাে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামীজি ভারতীয় আধ্যাত্ম সাধনার গৃঢ় মর্ম কথা এবং বেদান্তের বাণী প্রচারের দ্বারা আমেরিকাকে মুগ্ধ করলেন। বিশ্বজয়ের পর ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ এলেন লণ্ডনে। মার্গারেট স্বামীজির বক্তৃতা শুনে ভারতীয় দর্শনের প্রতি উত্তরােত্তর আকষ্ট হন। একদিন মার্গারেট স্বামীজিকে তার মনের সংশয়ের কথা বলেন। স্বামীজি তাকে ভারতীয় দর্শন-এর সারতত্ত্ব সরলভাবে বুঝিয়ে দিলেন।বিবেকানন্দের বাণী তাকে মহাজীবনের সন্ধান দিল। খণ্ড ক্ষুদ্রকে বর্জন করে সেই শাশ্বত এক আবনশ্বর ধ্যানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। গ্রহণ করলেন স্বামীজির শিষ্যত্ব। মার্গারেট বিবেকানন্দের ভিতরে খুঁজে পেলেন তাঁর ধ্যানের গুরুকে। মার্গারেটের ভিতরে বিবেকানন্দ দেখলেন একজন করুণাময়ী শুচিশুভ্র রমণীকে।

    ভারতে আগমন : ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্গারেট ইংল্যাণ্ডের নিকট হতে বিদায় নিয়ে ভারতভূমিতে পদার্পণ করলেন। সানন্দে নিজের মস্তকে তুলে নিলেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। স্বামীজি এই মহিয়সী নারীর অসাধারণ ত্যাগের স্বীকৃতি দান করে সর্বসমক্ষে সগৌরবে ঘােষণা করলেন – ইংল্যাণ্ড আমাদিগকে এক অমূল্য উপহার দিয়েছে, ভারত কল্যাণে আত্মনিবেদিতা এই নারীত্ব।’ স্বামীজিই মার্গারেটের নূতন নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। ভগিনী’ আখ্যা দিলেন সংঘভ্রাতা সন্ন্যাসীগণ।
    কর্মভার গ্রহণ : গুরুর আদেশ শিরােধার্য করে নিবেদিতা এবার অবতীর্ণা হলেন বাস্তব কর্মক্ষেত্রে। কলকাতায় বাগবাজার পল্লির বােস পাড়া অঞ্চলে এক অন্ধকার গৃহের ভিতর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করলেন নিবেদিতা। অতি কষ্টে কয়েকটি কিশােরীসহ কিছু বেশি সংখ্যক বয়স্কা কন্যা সংগ্রহ করে তিনি বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তাঁর শিক্ষাদানের প্রণালী ছিল অতি সহজ এবং অভিনব। পড়তে বসে মেয়েরা পড়ার চেয়ে বেশি আনন্দ পেত। শুধু পাঠ্যগ্রন্থের পড়া পড়িয়ে নিবেদিতা কর্তব্য শেষ করতেন না। ছাত্রীদের গল্পচ্ছলে উপদেশ দিতেন- হিন্দুর প্রাচীন আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা পােষণ করতে, রামায়ণ-মহাভারত থেকে সীতা, সাবিত্রী, গান্ধারি প্রভৃতি মহিয়সী রমণীদের আখ্যান শুনিয়ে ছাত্রীদের তাদের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। নারীজনােচিত চারুকলার শিক্ষা, আলপনা, সেলাই প্রভৃতির অনুশীলনও নিবেদিতার তত্ত্বাবধানে নিয়মিতভাবে হত।

    দেশসেবা : নিবেদিতা ভারতবর্ষকে মনে প্রাণে ভালােবেসে এদেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন। এদেশ ছিল তার স্বদেশ। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দেশে তখন স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে। ফাঁসির মঞ্চে, পুলিশের গুলিতে স্বদেশি বাঙালি যুবকেরা একের পর এক প্রাণ দিচ্ছে। রাজরােষে পতিত পলাতক সংগ্রামীরা অনেকেই নিবেদিতার নিকট ছিলেন অশেষ প্রকারে ঋণী। আন্তরিক সহানুভূতি, অর্থ সাহায্য তিনি অকাতরে বিতরণ করতেন। সাহিত্য-সাধনার মাধ্যমেও এই মহিয়সী মহিলা করে গেছেন ভারতের সেবা। তার রচিত ‘ক্লেডেটেলস্ অব হিন্দুইজম’, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আইসহি প্রভৃতি গ্রন্থে তার ভারত অনুরাগ ও গুরুভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

    প্রয়াণ : নিবেদিতা ভারতকে করে নিয়েছিলেন মনে প্রাণে আপন। নিষ্ঠাবতী ব্রহ্মচারিণীর জীবন যাপন করতেন তিনি। আচারে, ব্যবহারে, আহারে কোথাও ছিল না পাশ্চাত্যভাব। ধ্যান-ধারণা জীবন-চর্চায় তিনি ছিলেন খাঁটি ভারতীয়। মা সারদা তাকে সর্বদা নিজের কন্যা বলেই পরিচয় দিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘লােকমাতা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর ভগিনী নিবেদিতার জীবন দীপ হল নির্বাপিত।

    উপসংহারঃ ভগিনী নিবেদিতা নিজ বৈশিষ্ট্যে ভারতাত্মায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবাসীর তিনি মহিয়সী ভগিনী। তাঁর আত্মত্যাগের আদর্শ চিরদিন ভারতবাসীকে
    উদ্বুদ্ধ করবে।

    See less
  1. ভগিনী নিবেদিতা ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙRead more

    ভগিনী নিবেদিতা

    ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রকৃত ভগিনীর আসনে চির প্রতিষ্ঠাতা।

    জন্ম ও পরিচয় : ভগিনী নিবেদিতার জন্ম উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের ডানগ্যানন শহরে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে। তার পূর্ব নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নােবেল। পিতা স্যামুয়েল রিচমও নােবেলের অকাল মৃত্যু সমগ্র পরিবারকে ঠেলে দিয়েছিল দারিদ্র্যের মধ্যে। মার্গারেটের জননী দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাতামহ হ্যামিলটনের সংসারে। স্কুল ও কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে মার্গারেট রেক্সহ্যাম শহরে শিক্ষিকার কাজ, করতে লাগলেন। এই সময় তিনি আকৃষ্ট হলেন ওয়েলসবাসী এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের প্রতি। সেই ইঞ্জিনিয়ারের অকাল মৃত্যুর পর মার্গারেট রেক্সহামের চাকুরি ছেড়ে চলে এলেন চেস্টারে। শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে করতে লাগলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা।

    স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্য লাভ : ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিকাগাে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামীজি ভারতীয় আধ্যাত্ম সাধনার গৃঢ় মর্ম কথা এবং বেদান্তের বাণী প্রচারের দ্বারা আমেরিকাকে মুগ্ধ করলেন। বিশ্বজয়ের পর ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ এলেন লণ্ডনে। মার্গারেট স্বামীজির বক্তৃতা শুনে ভারতীয় দর্শনের প্রতি উত্তরােত্তর আকষ্ট হন। একদিন মার্গারেট স্বামীজিকে তার মনের সংশয়ের কথা বলেন। স্বামীজি তাকে ভারতীয় দর্শন-এর সারতত্ত্ব সরলভাবে বুঝিয়ে দিলেন।বিবেকানন্দের বাণী তাকে মহাজীবনের সন্ধান দিল। খণ্ড ক্ষুদ্রকে বর্জন করে সেই শাশ্বত এক আবনশ্বর ধ্যানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। গ্রহণ করলেন স্বামীজির শিষ্যত্ব। মার্গারেট বিবেকানন্দের ভিতরে খুঁজে পেলেন তাঁর ধ্যানের গুরুকে। মার্গারেটের ভিতরে বিবেকানন্দ দেখলেন একজন করুণাময়ী শুচিশুভ্র রমণীকে।

    ভারতে আগমন : ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্গারেট ইংল্যাণ্ডের নিকট হতে বিদায় নিয়ে ভারতভূমিতে পদার্পণ করলেন। সানন্দে নিজের মস্তকে তুলে নিলেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। স্বামীজি এই মহিয়সী নারীর অসাধারণ ত্যাগের স্বীকৃতি দান করে সর্বসমক্ষে সগৌরবে ঘােষণা করলেন – ইংল্যাণ্ড আমাদিগকে এক অমূল্য উপহার দিয়েছে, ভারত কল্যাণে আত্মনিবেদিতা এই নারীত্ব।’ স্বামীজিই মার্গারেটের নূতন নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। ভগিনী’ আখ্যা দিলেন সংঘভ্রাতা সন্ন্যাসীগণ।
    কর্মভার গ্রহণ : গুরুর আদেশ শিরােধার্য করে নিবেদিতা এবার অবতীর্ণা হলেন বাস্তব কর্মক্ষেত্রে। কলকাতায় বাগবাজার পল্লির বােস পাড়া অঞ্চলে এক অন্ধকার গৃহের ভিতর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করলেন নিবেদিতা। অতি কষ্টে কয়েকটি কিশােরীসহ কিছু বেশি সংখ্যক বয়স্কা কন্যা সংগ্রহ করে তিনি বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তাঁর শিক্ষাদানের প্রণালী ছিল অতি সহজ এবং অভিনব। পড়তে বসে মেয়েরা পড়ার চেয়ে বেশি আনন্দ পেত। শুধু পাঠ্যগ্রন্থের পড়া পড়িয়ে নিবেদিতা কর্তব্য শেষ করতেন না। ছাত্রীদের গল্পচ্ছলে উপদেশ দিতেন- হিন্দুর প্রাচীন আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা পােষণ করতে, রামায়ণ-মহাভারত থেকে সীতা, সাবিত্রী, গান্ধারি প্রভৃতি মহিয়সী রমণীদের আখ্যান শুনিয়ে ছাত্রীদের তাদের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। নারীজনােচিত চারুকলার শিক্ষা, আলপনা, সেলাই প্রভৃতির অনুশীলনও নিবেদিতার তত্ত্বাবধানে নিয়মিতভাবে হত।

    দেশসেবা : নিবেদিতা ভারতবর্ষকে মনে প্রাণে ভালােবেসে এদেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন। এদেশ ছিল তার স্বদেশ। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দেশে তখন স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে। ফাঁসির মঞ্চে, পুলিশের গুলিতে স্বদেশি বাঙালি যুবকেরা একের পর এক প্রাণ দিচ্ছে। রাজরােষে পতিত পলাতক সংগ্রামীরা অনেকেই নিবেদিতার নিকট ছিলেন অশেষ প্রকারে ঋণী। আন্তরিক সহানুভূতি, অর্থ সাহায্য তিনি অকাতরে বিতরণ করতেন। সাহিত্য-সাধনার মাধ্যমেও এই মহিয়সী মহিলা করে গেছেন ভারতের সেবা। তার রচিত ‘ক্লেডেটেলস্ অব হিন্দুইজম’, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আইসহি প্রভৃতি গ্রন্থে তার ভারত অনুরাগ ও গুরুভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।

    প্রয়াণ : নিবেদিতা ভারতকে করে নিয়েছিলেন মনে প্রাণে আপন। নিষ্ঠাবতী ব্রহ্মচারিণীর জীবন যাপন করতেন তিনি। আচারে, ব্যবহারে, আহারে কোথাও ছিল না পাশ্চাত্যভাব। ধ্যান-ধারণা জীবন-চর্চায় তিনি ছিলেন খাঁটি ভারতীয়। মা সারদা তাকে সর্বদা নিজের কন্যা বলেই পরিচয় দিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘লােকমাতা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর ভগিনী নিবেদিতার জীবন দীপ হল নির্বাপিত।

    উপসংহারঃ ভগিনী নিবেদিতা নিজ বৈশিষ্ট্যে ভারতাত্মায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবাসীর তিনি মহিয়সী ভগিনী। তাঁর আত্মত্যাগের আদর্শ চিরদিন ভারতবাসীকে
    উদ্বুদ্ধ করবে।

    See less
  1. শরৎকাল সূচনা: ঋতুররানী শরৎ কাল, বাংলার তৃতীয় ঋতু। বর্ষার ঘন বাদল বৃষ্টি শেষ হলে আগমন ঘটে শরতের। ভাদ্র আশ্বিন মাস নিয়ে গঠিত এই ঋতু। এই ঋতুতে এই দূর্গা বাংলা মায়ের আবির্ভাব ঘটে এবং সমস্ত বাংলা জুড়ে উদযাপিত হয় দুর্গোৎসব। শরৎ এর বৈশিষ্ট্য: শ্রাবণ শেষে অবিরত বৃষ্টির বিরাম ঘটলেই প্রকৃতি নতুন রূপে সাজRead more

    শরৎকাল

    সূচনা: ঋতুররানী শরৎ কাল, বাংলার তৃতীয় ঋতু। বর্ষার ঘন বাদল বৃষ্টি শেষ হলে আগমন ঘটে শরতের। ভাদ্র আশ্বিন মাস নিয়ে গঠিত এই ঋতু। এই ঋতুতে এই দূর্গা বাংলা মায়ের আবির্ভাব ঘটে এবং সমস্ত বাংলা জুড়ে উদযাপিত হয় দুর্গোৎসব।

    শরৎ এর বৈশিষ্ট্য: শ্রাবণ শেষে অবিরত বৃষ্টির বিরাম ঘটলেই প্রকৃতি নতুন রূপে সাজে। আকাশের বুকে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ, রোদ হয় ঝলমলে আর বাতাস হয় নির্মল। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মত উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। শরৎ নিয়ে আসে এক মাধুর্য।ফলে যাহার পৃথিবী এক অপরূপ মহিমায় পরিণত হয়। সূর্যের আলোয় সবুজ ধানের ক্ষেত হয়ে মনমুগ্ধকর।

    শরৎ কালের রুপ: শরৎকালের প্রকৃতিতে লক্ষ করা যায় এক অনন্য রূপ। গাছপালা বৃক্ষ হয়ে ওঠে সতেজ ও সুন্দর ।‌ চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি মনে হয়। ধানের ক্ষেতের মাঠ হয়ে ওঠে সবুজ প্রান্তর । নদীর ধারে উঠে উঁকি দেয় সাদা সাদা কাশফুল। শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মত বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরন রং মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের আগমনে বাংলার বন কোয়েল, দোয়েল ময়নার কল কাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে। সাজে এক অপরূপ সাজে।

    শরতের দুর্গোৎসব: শরৎকাল এর মূল আকর্ষণ দুর্গোৎসব বা দূর্গাপুজা। যা বাঙালির প্রধান উৎসব। তাই দুর্গাপূজা কে শারদীয় উৎসবে বলা হয় । দুর্গা মায়ের আগমনের জন্য বাঙালি অপেক্ষা করে সারা বছর ধরে। সেই অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে দুর্গা মা নিয়ে আসেন আনন্দ বাংলার ঘরে ঘরে। আকাশে বাতাসে মুখরিত হয় বাংলা মায়ের আগমনের ধ্বনি। উৎসবের আনন্দে বাঙালি হয় মাতোয়ারা। স্কুলের ছুটি হলে ছোটদের মধ্যে আনন্দের সীমা থাকে না। বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা ছাড়াও লক্ষ্মীপূজা কালীপূজা এই শরৎ কালেই উদযাপিত হয়।

    উপসংহার: আকাশের সাদা মেঘের ভেলা আর নদীতীরে সাদা কাশফূল,ভোরে হালকা শিউলিভেজা শিউলিফুল আর দূর্গা মায়ের আগমন সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুভ্রতার ঋতু।শরৎকালে রাতের বেলায় জ্যোৎস্নার রূপ অপরূপ ।মেঘমুক্ত আকাশ থেকে কল্প কথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে পৃথিবীতে।শরতের জ্যোৎস্নার মোহিত রূপ নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যায় না । বলা যায়, শরৎ বাংলার ঋতু – ঋতুর রানী।

    See less