পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার (Paribesh dushan o tar protikar)
ভূমিকা : মানুষের হাতেই যেন ঝলসে ওঠেছে মানুষের মৃত্যুবাণ। নিজেই
সে করতে চলেছে নিজের ধ্বংস সাধন। নইলে কেন আজ শুনা যায় সভ্যতার
নাভিশ্বাস ? সর্বং সহা পৃথিবী যেন আজ হারিয়ে ফেলেছে তার সহ্যের সীমা। নিজের
সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মিটাতেই মানুষ আজ নিঙড়ে নিচ্ছে পৃথিবীতে। এতে কার হচ্ছে
সর্বনাশ ? কার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে বিপন্ন ? আজ পৃথিবীর হাজারও সমস্যার মধ্যে
যেটা সবচাইতে বড় সমস্যা সেটাই হচ্ছে পরিবেশ দূষণ।
পরিবেশ : যে পারিপার্শ্বিকতা আমাদের দেহ মনকে প্রভাবিত করে তার
সম্মিলিত সমাহারই হলাে আমাদের পরিবেশ। বাস্তবিকই আমাদের চারিপাশে অবস্থিত
উদার আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, গাছগাছালি, নানাজাতের প্রাণী, ঝোপ, লতা,
গুল্ম, মরুপ্রান্তের কীট, পতঙ্গ, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, এ সবাইকে নিয়েই বসবাস
করাই আমাদের পরিবেশ।
পরিবেশ দূষণ : দূষণ বা ইংরেজিতে Pollution শব্দটি ল্যাটিন শব্দ
Pollution হতে উৎপন্ন। সাধারণ অর্থে পরিবেশের ক্ষতিকর বস্তুর প্রাধান্যকে
দূষণ বা Pollution বলা হয়। আমাদের প্রতিদিনের বিভিন্ন কাজের কুলম্করপ
আমাদের প্রকৃতিতে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে, নান প্রকার রােগের সৃষ্টি হচ্ছে,
পর্বের সে মুক্ত বাতাস আর বিশুদ্ধ জল আমরা আর পাচ্ছিনা। এটাই দুষণ। তাই
বাতাস, জল আর মাটি দুষিত হওয়াকেই এক কথায় বলা হয় পরিবেশ দূষণ। তাছাড়া
শব্দ দূষণের পরিবেশ দূষণের অন্তর্গত।
পরিবেশ দূষণের কারণ : সৃষ্টির উষা-লগ্নে আবহাওয়ার অনুকুল পরিবেশে
একদিন এ পৃথিবীতে জীবন ছিল সুন্দর।খাদ্য ও জলে ছিল বিশুদ্ধতা । কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি
আর বিজ্ঞানের প্রাধান্য পৃথিবীর বুকে নিয়ে এল এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়।
ক্ষতি হয়ে চলল উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণীজগৎ। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এভাবে
এসে দাড়িয়েছে এক বিপদজনক অবস্থায়।
বায়ু দূষণ – প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ যে ছিন্নমস্তা রূপ ধারণ করতে
চলেছে তার মূলে রয়েছে বায়ু দূষণ। প্রাণী জগতে প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়ােজন নিল
বায়ুর। জল ও খাদ্য ছাড়া মানুষ দু-চার দিন বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু বায়ু অর্থাৎ
বাতাস ছাড়া মানুষ বা প্রাণী এক মুহূর্তও বেচে থাকতে পারে না। বায়ু দুষিত হলে
অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক দুষিত গ্যাস আমাদের
দেহে প্রবেশ করবে। এই অক্সিজেনের যােগান দেয় গাছ-পালা, এজন্য প্রাণী জগৎ বেঁচে
আছে। তাই অরণ্য হল মানব জগতের ফুসফুস। সে অরণা আজ ফবংসের মুখে।
মানুষ একদিন প্রয়ােজনের তাগিদে অরণ্য কেটে বসতি স্থাপন করেছিল আর
আজ তাদের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য করেছে অরণ্য ছেদন। যান্ত্রিক সভ্যতায় কল
কারখানার ধোঁয়া, অপরিচ্ছন্ন শহরের ধুলা-বালু, রাস্তার ধারে জ্বালানাে কয়লার ঘোষ
ইত্যাদি বাতাসকে করছে বিষাক্ত। ফলে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ক্রম বর্ধমান, অকাল
বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড় এর মূলে বায়ু দূষণের অভিশাপ। এই দূষিত বায়ু নিশ্বাসকে নিষ্ট করে
ফুসফুসকে দ্রুত জীর্ণ করে দেয়, ফলে শ্বাস রােগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি রােগ
দেখা দেয়।
জল দূষণ : জলের অপর নাম জীবন। জলছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না।
অথচ এই জলই দূষিত হয়ে মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়। প্রকৃতি প্রদত্ত মুক্ত এ
বস্তুটিও আধুনিক সভ্যতার করাল গ্রাস হতে রক্ষা পায়নি। বড় বড় নদীতে আজ দুষিত
জলের ধারা বহে চলেছে। কল-কারখানার এবং পয়ঃ প্রণালীর পরিত্যজ্য জল নালা
নর্দমার মাধ্যমে জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হিন্দু ধর্মে ও লােকাচারে গঙ্গানদী অতি পবিত্র নদী। স্নান-পান ও স্পর্শে মুক্তি।
গঙ্গা ভগীরথ আনিত ও বিষ্ণু পদ গলিত ধারা সে বিশ্বাস আজ আর নেই। গঙ্গার
সুদীর্ঘ তীরবর্তী গ্রাম জনপথ ও শহরের বর্জ্য পদার্থ পূণ্য সলিলা গঙ্গায় বিসর্জিত
হচ্ছে। কিভাবে দূষিত জলের সমস্যা আজ সারা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এই দূষণের
ফলে বিনষ্ট হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। অকাল মৃত্যু হানা দিচ্ছে ঘরে ঘরে।
মাটি দূষণ : পৃথিবীর অন্যতম উপাদান মাটি উদ্ভিদ জগৎকে প্রতাক্ষভাবে
এবং প্রাণী জগৎকে পরােক্ষভাবে রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু নানধরনের জঞ্জাল, পরিত্যক্ত
পদার্থ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটি-দূষণের জন্য দায়ি।
নিউক্লীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নিউক্লীয় বিস্ফোরণ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটিতে
দূষণ সৃষ্টি করে। এই মাটির উদ্ভিদ তেজস্ক্রিয় পদার্থ সঞ্চিত হয়। আর এই উদ্ভিদ
খাদ্য হিসেবে প্রাণীর দেহে গেলে নানা রোগের সৃষ্টি হয়।
গ্রাম দূষণ ও এই দূষণের হাত থেকে ছায়া সুনিবিড় গ্রামাঞ্চলও বাদ যায়নি।
মাটি দূষণ তাে গ্রামের বুকেই ঘটছে। স্থানে স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ, শ্মশান, ভাগাড় ইত্যাদি
দূষিত পদার্থ আর বর্জিত পদার্থের স্তুপ। সংস্কৃত পুকুর, ডােবার নােংরা পটা জাল
নির্মল গ্রামকেও আজ ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে।
শব্দ-দূষণ : শব্দ দূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ। গ্রামের
তুলনায় শহরে এর উপদ্রব বেশি। প্রতিনিয়তই আমরা আছি শব্দের জগতে কিন্তু তা
যখন কানের কাছে অসহ্য হয়ে উঠে তখনই তাকে বলে শব্দ দূষণ। বিজ্ঞানীদের মতে
২০থেকে ৬০ ডেসিবেল শব্দ সহ্য করবার ক্ষমতা থাকে মানুষের কিন্তু তা যখন এর
মাত্রা ছাড়ায় তখনই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ক্রমাগত মোটর গাড়ি, ট্রাক, ট্রেন,
বাইক, বৈদ্যুতিক হর্ণের কর্কশতা, মাইকের শব্দ, বোমা বাজি, পটকার ধ্বনি ইত্যাদি
অহরহ পাল্লা দিয়ে শব্দ দূষণ করে চলেছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় মানুষের
কানের। তাছাড়া মানসিক ক্ষতিও করে, রক্তচাপ বাড়ায়, হৃৎপিণ্ডের অসুখ ও অনিদ্রা
রােগ দেখা দেয়।
প্রতিকার : পরিবেশ দূষণ রূপ ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূতের হাত থেকে পৃথিবী
তথা প্রাণী জগৎকে রক্ষা করতে দেরিতে হলেও সচেতনতা শুধু হয়েছে। বিভিন্ন দেশের
বৈজ্ঞানিকগণ পরিবেশকে রক্ষা করতে সচেতন হয়ে ওঠেছেন।
প্রকৃতির মধ্যেই বায়ু বিশুদ্ধকরণের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। সবুজ উদ্ভিদরা
বাতাস থেকে বিপুল পরিমাণে দূষিত গ্যাস ও ক্ষতিকর সুক্ষ্ম কণিকা সংগ্রহ করে
বাতাসকে বিশুদ্ধ করে থাকে। সুতরাং বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করে বনভূমি বাড়াতে হবে
অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে গাছপালা লাগাতে হবে শিলাঞ্চল ও শহরগুলিতে।
কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, শহরাঞ্চলের নাগরিকদের ব্যবহৃত আবর্জনা নদী
বা সাগরের জলে ফেলা বন্ধ করতে হবে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক ও
সার যাতে জলের সাথে না মিশে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস : বিশ্ব জুড়েই আজ পরিবেশ সংকট। সেই সংকট
দূর করতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা রত। দূষণের ভয়াবহতা ঘুম কেড়ে নিয়েছে মানবতাবাদী
আর চিন্তাশীল মানুষের। চিন্তিত রাষ্ট্রপুঞ্জ। তাই রাষ্ট্রসংঘ ৫ জুন কি ঘােষণা করেছে বিশ্ব
পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করতে। যাতে মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
১৯৭২ সন থেকে প্রতি বছরই ওই দিনটি পালিত হচ্ছে। প্রতিবারেই ওই দিনটি নাড়া
দিয়ে যায় বিশ্ব বিবেককে। গ্রহণ করা হয় নতুন শপথ।
উপসংহার : পরিবেশ যতই দুষিত হােক না কেন সুষ্ঠু ভাবে বাঁচতে হলে
তাকে পরিশােধন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর জন্য প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক
মানসিকতা, শিক্ষা ও সচেতনতার। এই পৃথিবীকে অর্থাৎ আমাদের একমাত্র বাসস্থানকে
আমরা যদি নিজেই ধ্বংস করি তা হলে নিজেদেরই মৃত্যু ডেকে আনব আমরা তাই এ
কথা সর্বদা আমাদের মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীকে সুন্দর ও সুষ্টু রাখা আমাদের
দায়িত্ব ও কর্তব্য।
Hridoy
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার (Paribesh dushan o tar protikar)
ভূমিকা : মানুষের হাতেই যেন ঝলসে ওঠেছে মানুষের মৃত্যুবাণ। নিজেই
সে করতে চলেছে নিজের ধ্বংস সাধন। নইলে কেন আজ শুনা যায় সভ্যতার
নাভিশ্বাস ? সর্বং সহা পৃথিবী যেন আজ হারিয়ে ফেলেছে তার সহ্যের সীমা। নিজের
সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মিটাতেই মানুষ আজ নিঙড়ে নিচ্ছে পৃথিবীতে। এতে কার হচ্ছে
সর্বনাশ ? কার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়েছে বিপন্ন ? আজ পৃথিবীর হাজারও সমস্যার মধ্যে
যেটা সবচাইতে বড় সমস্যা সেটাই হচ্ছে পরিবেশ দূষণ।
পরিবেশ : যে পারিপার্শ্বিকতা আমাদের দেহ মনকে প্রভাবিত করে তার
সম্মিলিত সমাহারই হলাে আমাদের পরিবেশ। বাস্তবিকই আমাদের চারিপাশে অবস্থিত
উদার আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, গাছগাছালি, নানাজাতের প্রাণী, ঝোপ, লতা,
গুল্ম, মরুপ্রান্তের কীট, পতঙ্গ, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, এ সবাইকে নিয়েই বসবাস
করাই আমাদের পরিবেশ।
পরিবেশ দূষণ : দূষণ বা ইংরেজিতে Pollution শব্দটি ল্যাটিন শব্দ
Pollution হতে উৎপন্ন। সাধারণ অর্থে পরিবেশের ক্ষতিকর বস্তুর প্রাধান্যকে
দূষণ বা Pollution বলা হয়। আমাদের প্রতিদিনের বিভিন্ন কাজের কুলম্করপ
আমাদের প্রকৃতিতে যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে, নান প্রকার রােগের সৃষ্টি হচ্ছে,
পর্বের সে মুক্ত বাতাস আর বিশুদ্ধ জল আমরা আর পাচ্ছিনা। এটাই দুষণ। তাই
বাতাস, জল আর মাটি দুষিত হওয়াকেই এক কথায় বলা হয় পরিবেশ দূষণ। তাছাড়া
শব্দ দূষণের পরিবেশ দূষণের অন্তর্গত।
পরিবেশ দূষণের কারণ : সৃষ্টির উষা-লগ্নে আবহাওয়ার অনুকুল পরিবেশে
একদিন এ পৃথিবীতে জীবন ছিল সুন্দর।খাদ্য ও জলে ছিল বিশুদ্ধতা । কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি
আর বিজ্ঞানের প্রাধান্য পৃথিবীর বুকে নিয়ে এল এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়।
ক্ষতি হয়ে চলল উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণীজগৎ। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এভাবে
এসে দাড়িয়েছে এক বিপদজনক অবস্থায়।
বায়ু দূষণ – প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ যে ছিন্নমস্তা রূপ ধারণ করতে
চলেছে তার মূলে রয়েছে বায়ু দূষণ। প্রাণী জগতে প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়ােজন নিল
বায়ুর। জল ও খাদ্য ছাড়া মানুষ দু-চার দিন বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু বায়ু অর্থাৎ
বাতাস ছাড়া মানুষ বা প্রাণী এক মুহূর্তও বেচে থাকতে পারে না। বায়ু দুষিত হলে
অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক দুষিত গ্যাস আমাদের
দেহে প্রবেশ করবে। এই অক্সিজেনের যােগান দেয় গাছ-পালা, এজন্য প্রাণী জগৎ বেঁচে
আছে। তাই অরণ্য হল মানব জগতের ফুসফুস। সে অরণা আজ ফবংসের মুখে।
মানুষ একদিন প্রয়ােজনের তাগিদে অরণ্য কেটে বসতি স্থাপন করেছিল আর
আজ তাদের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য করেছে অরণ্য ছেদন। যান্ত্রিক সভ্যতায় কল
কারখানার ধোঁয়া, অপরিচ্ছন্ন শহরের ধুলা-বালু, রাস্তার ধারে জ্বালানাে কয়লার ঘোষ
ইত্যাদি বাতাসকে করছে বিষাক্ত। ফলে আবহাওয়ার তাপমাত্রা ক্রম বর্ধমান, অকাল
বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড় এর মূলে বায়ু দূষণের অভিশাপ। এই দূষিত বায়ু নিশ্বাসকে নিষ্ট করে
ফুসফুসকে দ্রুত জীর্ণ করে দেয়, ফলে শ্বাস রােগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি রােগ
দেখা দেয়।
জল দূষণ : জলের অপর নাম জীবন। জলছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না।
অথচ এই জলই দূষিত হয়ে মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়। প্রকৃতি প্রদত্ত মুক্ত এ
বস্তুটিও আধুনিক সভ্যতার করাল গ্রাস হতে রক্ষা পায়নি। বড় বড় নদীতে আজ দুষিত
জলের ধারা বহে চলেছে। কল-কারখানার এবং পয়ঃ প্রণালীর পরিত্যজ্য জল নালা
নর্দমার মাধ্যমে জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হিন্দু ধর্মে ও লােকাচারে গঙ্গানদী অতি পবিত্র নদী। স্নান-পান ও স্পর্শে মুক্তি।
গঙ্গা ভগীরথ আনিত ও বিষ্ণু পদ গলিত ধারা সে বিশ্বাস আজ আর নেই। গঙ্গার
সুদীর্ঘ তীরবর্তী গ্রাম জনপথ ও শহরের বর্জ্য পদার্থ পূণ্য সলিলা গঙ্গায় বিসর্জিত
হচ্ছে। কিভাবে দূষিত জলের সমস্যা আজ সারা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এই দূষণের
ফলে বিনষ্ট হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। অকাল মৃত্যু হানা দিচ্ছে ঘরে ঘরে।
মাটি দূষণ : পৃথিবীর অন্যতম উপাদান মাটি উদ্ভিদ জগৎকে প্রতাক্ষভাবে
এবং প্রাণী জগৎকে পরােক্ষভাবে রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু নানধরনের জঞ্জাল, পরিত্যক্ত
পদার্থ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটি-দূষণের জন্য দায়ি।
নিউক্লীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নিউক্লীয় বিস্ফোরণ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মাটিতে
দূষণ সৃষ্টি করে। এই মাটির উদ্ভিদ তেজস্ক্রিয় পদার্থ সঞ্চিত হয়। আর এই উদ্ভিদ
খাদ্য হিসেবে প্রাণীর দেহে গেলে নানা রোগের সৃষ্টি হয়।
গ্রাম দূষণ ও এই দূষণের হাত থেকে ছায়া সুনিবিড় গ্রামাঞ্চলও বাদ যায়নি।
মাটি দূষণ তাে গ্রামের বুকেই ঘটছে। স্থানে স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ, শ্মশান, ভাগাড় ইত্যাদি
দূষিত পদার্থ আর বর্জিত পদার্থের স্তুপ। সংস্কৃত পুকুর, ডােবার নােংরা পটা জাল
নির্মল গ্রামকেও আজ ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে।
শব্দ-দূষণ : শব্দ দূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ। গ্রামের
তুলনায় শহরে এর উপদ্রব বেশি। প্রতিনিয়তই আমরা আছি শব্দের জগতে কিন্তু তা
যখন কানের কাছে অসহ্য হয়ে উঠে তখনই তাকে বলে শব্দ দূষণ। বিজ্ঞানীদের মতে
২০থেকে ৬০ ডেসিবেল শব্দ সহ্য করবার ক্ষমতা থাকে মানুষের কিন্তু তা যখন এর
মাত্রা ছাড়ায় তখনই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ক্রমাগত মোটর গাড়ি, ট্রাক, ট্রেন,
বাইক, বৈদ্যুতিক হর্ণের কর্কশতা, মাইকের শব্দ, বোমা বাজি, পটকার ধ্বনি ইত্যাদি
অহরহ পাল্লা দিয়ে শব্দ দূষণ করে চলেছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় মানুষের
কানের। তাছাড়া মানসিক ক্ষতিও করে, রক্তচাপ বাড়ায়, হৃৎপিণ্ডের অসুখ ও অনিদ্রা
রােগ দেখা দেয়।
প্রতিকার : পরিবেশ দূষণ রূপ ভয়ঙ্কর মৃত্যুদূতের হাত থেকে পৃথিবী
তথা প্রাণী জগৎকে রক্ষা করতে দেরিতে হলেও সচেতনতা শুধু হয়েছে। বিভিন্ন দেশের
বৈজ্ঞানিকগণ পরিবেশকে রক্ষা করতে সচেতন হয়ে ওঠেছেন।
প্রকৃতির মধ্যেই বায়ু বিশুদ্ধকরণের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। সবুজ উদ্ভিদরা
বাতাস থেকে বিপুল পরিমাণে দূষিত গ্যাস ও ক্ষতিকর সুক্ষ্ম কণিকা সংগ্রহ করে
বাতাসকে বিশুদ্ধ করে থাকে। সুতরাং বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করে বনভূমি বাড়াতে হবে
অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে গাছপালা লাগাতে হবে শিলাঞ্চল ও শহরগুলিতে।
কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, শহরাঞ্চলের নাগরিকদের ব্যবহৃত আবর্জনা নদী
বা সাগরের জলে ফেলা বন্ধ করতে হবে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিষাক্ত কীটনাশক ও
সার যাতে জলের সাথে না মিশে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস : বিশ্ব জুড়েই আজ পরিবেশ সংকট। সেই সংকট
দূর করতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা রত। দূষণের ভয়াবহতা ঘুম কেড়ে নিয়েছে মানবতাবাদী
আর চিন্তাশীল মানুষের। চিন্তিত রাষ্ট্রপুঞ্জ। তাই রাষ্ট্রসংঘ ৫ জুন কি ঘােষণা করেছে বিশ্ব
পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করতে। যাতে মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
১৯৭২ সন থেকে প্রতি বছরই ওই দিনটি পালিত হচ্ছে। প্রতিবারেই ওই দিনটি নাড়া
দিয়ে যায় বিশ্ব বিবেককে। গ্রহণ করা হয় নতুন শপথ।
উপসংহার : পরিবেশ যতই দুষিত হােক না কেন সুষ্ঠু ভাবে বাঁচতে হলে
তাকে পরিশােধন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর জন্য প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক
মানসিকতা, শিক্ষা ও সচেতনতার। এই পৃথিবীকে অর্থাৎ আমাদের একমাত্র বাসস্থানকে
আমরা যদি নিজেই ধ্বংস করি তা হলে নিজেদেরই মৃত্যু ডেকে আনব আমরা তাই এ
কথা সর্বদা আমাদের মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীকে সুন্দর ও সুষ্টু রাখা আমাদের
দায়িত্ব ও কর্তব্য।