ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রকৃত ভগিনীর আসনে চির প্রতিষ্ঠাতা।
জন্ম ও পরিচয় : ভগিনী নিবেদিতার জন্ম উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের ডানগ্যানন শহরে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে। তার পূর্ব নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নােবেল। পিতা স্যামুয়েল রিচমও নােবেলের অকাল মৃত্যু সমগ্র পরিবারকে ঠেলে দিয়েছিল দারিদ্র্যের মধ্যে। মার্গারেটের জননী দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাতামহ হ্যামিলটনের সংসারে। স্কুল ও কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে মার্গারেট রেক্সহ্যাম শহরে শিক্ষিকার কাজ, করতে লাগলেন। এই সময় তিনি আকৃষ্ট হলেন ওয়েলসবাসী এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের প্রতি। সেই ইঞ্জিনিয়ারের অকাল মৃত্যুর পর মার্গারেট রেক্সহামের চাকুরি ছেড়ে চলে এলেন চেস্টারে। শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে করতে লাগলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা।
স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্য লাভ : ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিকাগাে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামীজি ভারতীয় আধ্যাত্ম সাধনার গৃঢ় মর্ম কথা এবং বেদান্তের বাণী প্রচারের দ্বারা আমেরিকাকে মুগ্ধ করলেন। বিশ্বজয়ের পর ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ এলেন লণ্ডনে। মার্গারেট স্বামীজির বক্তৃতা শুনে ভারতীয় দর্শনের প্রতি উত্তরােত্তর আকষ্ট হন। একদিন মার্গারেট স্বামীজিকে তার মনের সংশয়ের কথা বলেন। স্বামীজি তাকে ভারতীয় দর্শন-এর সারতত্ত্ব সরলভাবে বুঝিয়ে দিলেন।বিবেকানন্দের বাণী তাকে মহাজীবনের সন্ধান দিল। খণ্ড ক্ষুদ্রকে বর্জন করে সেই শাশ্বত এক আবনশ্বর ধ্যানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। গ্রহণ করলেন স্বামীজির শিষ্যত্ব। মার্গারেট বিবেকানন্দের ভিতরে খুঁজে পেলেন তাঁর ধ্যানের গুরুকে। মার্গারেটের ভিতরে বিবেকানন্দ দেখলেন একজন করুণাময়ী শুচিশুভ্র রমণীকে।
ভারতে আগমন : ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্গারেট ইংল্যাণ্ডের নিকট হতে বিদায় নিয়ে ভারতভূমিতে পদার্পণ করলেন। সানন্দে নিজের মস্তকে তুলে নিলেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। স্বামীজি এই মহিয়সী নারীর অসাধারণ ত্যাগের স্বীকৃতি দান করে সর্বসমক্ষে সগৌরবে ঘােষণা করলেন – ইংল্যাণ্ড আমাদিগকে এক অমূল্য উপহার দিয়েছে, ভারত কল্যাণে আত্মনিবেদিতা এই নারীত্ব।’ স্বামীজিই মার্গারেটের নূতন নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। ভগিনী’ আখ্যা দিলেন সংঘভ্রাতা সন্ন্যাসীগণ।
কর্মভার গ্রহণ : গুরুর আদেশ শিরােধার্য করে নিবেদিতা এবার অবতীর্ণা হলেন বাস্তব কর্মক্ষেত্রে। কলকাতায় বাগবাজার পল্লির বােস পাড়া অঞ্চলে এক অন্ধকার গৃহের ভিতর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করলেন নিবেদিতা। অতি কষ্টে কয়েকটি কিশােরীসহ কিছু বেশি সংখ্যক বয়স্কা কন্যা সংগ্রহ করে তিনি বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তাঁর শিক্ষাদানের প্রণালী ছিল অতি সহজ এবং অভিনব। পড়তে বসে মেয়েরা পড়ার চেয়ে বেশি আনন্দ পেত। শুধু পাঠ্যগ্রন্থের পড়া পড়িয়ে নিবেদিতা কর্তব্য শেষ করতেন না। ছাত্রীদের গল্পচ্ছলে উপদেশ দিতেন- হিন্দুর প্রাচীন আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা পােষণ করতে, রামায়ণ-মহাভারত থেকে সীতা, সাবিত্রী, গান্ধারি প্রভৃতি মহিয়সী রমণীদের আখ্যান শুনিয়ে ছাত্রীদের তাদের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। নারীজনােচিত চারুকলার শিক্ষা, আলপনা, সেলাই প্রভৃতির অনুশীলনও নিবেদিতার তত্ত্বাবধানে নিয়মিতভাবে হত।
দেশসেবা : নিবেদিতা ভারতবর্ষকে মনে প্রাণে ভালােবেসে এদেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন। এদেশ ছিল তার স্বদেশ। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দেশে তখন স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে। ফাঁসির মঞ্চে, পুলিশের গুলিতে স্বদেশি বাঙালি যুবকেরা একের পর এক প্রাণ দিচ্ছে। রাজরােষে পতিত পলাতক সংগ্রামীরা অনেকেই নিবেদিতার নিকট ছিলেন অশেষ প্রকারে ঋণী। আন্তরিক সহানুভূতি, অর্থ সাহায্য তিনি অকাতরে বিতরণ করতেন। সাহিত্য-সাধনার মাধ্যমেও এই মহিয়সী মহিলা করে গেছেন ভারতের সেবা। তার রচিত ‘ক্লেডেটেলস্ অব হিন্দুইজম’, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আইসহি প্রভৃতি গ্রন্থে তার ভারত অনুরাগ ও গুরুভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রয়াণ : নিবেদিতা ভারতকে করে নিয়েছিলেন মনে প্রাণে আপন। নিষ্ঠাবতী ব্রহ্মচারিণীর জীবন যাপন করতেন তিনি। আচারে, ব্যবহারে, আহারে কোথাও ছিল না পাশ্চাত্যভাব। ধ্যান-ধারণা জীবন-চর্চায় তিনি ছিলেন খাঁটি ভারতীয়। মা সারদা তাকে সর্বদা নিজের কন্যা বলেই পরিচয় দিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘লােকমাতা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর ভগিনী নিবেদিতার জীবন দীপ হল নির্বাপিত।
উপসংহারঃ ভগিনী নিবেদিতা নিজ বৈশিষ্ট্যে ভারতাত্মায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবাসীর তিনি মহিয়সী ভগিনী। তাঁর আত্মত্যাগের আদর্শ চিরদিন ভারতবাসীকে
উদ্বুদ্ধ করবে।
Hridoy
ভগিনী নিবেদিতা
ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরােধা স্বামী বিবেকানন্দ। আর ভারতমাতার পায়ে তারই শ্রেষ্ঠ উপহার ভগিনী নিবেদিতা। নিবেদিতা আপন সেবাধর্মে, মমতায়, ত্যাগে ও দরদে দেশবাসীর ভগিনী রূপে আখ্যাত। স্বামী বিবেকানন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভারতে এসে ভারতবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি দেশবাসীর প্রকৃত ভগিনীর আসনে চির প্রতিষ্ঠাতা।
জন্ম ও পরিচয় : ভগিনী নিবেদিতার জন্ম উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডের ডানগ্যানন শহরে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে। তার পূর্ব নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নােবেল। পিতা স্যামুয়েল রিচমও নােবেলের অকাল মৃত্যু সমগ্র পরিবারকে ঠেলে দিয়েছিল দারিদ্র্যের মধ্যে। মার্গারেটের জননী দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাতামহ হ্যামিলটনের সংসারে। স্কুল ও কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত করে মার্গারেট রেক্সহ্যাম শহরে শিক্ষিকার কাজ, করতে লাগলেন। এই সময় তিনি আকৃষ্ট হলেন ওয়েলসবাসী এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের প্রতি। সেই ইঞ্জিনিয়ারের অকাল মৃত্যুর পর মার্গারেট রেক্সহামের চাকুরি ছেড়ে চলে এলেন চেস্টারে। শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে করতে লাগলেন পরীক্ষা নিরীক্ষা।
স্বামী বিবেকানন্দের সান্নিধ্য লাভ : ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিকাগাে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে স্বামীজি ভারতীয় আধ্যাত্ম সাধনার গৃঢ় মর্ম কথা এবং বেদান্তের বাণী প্রচারের দ্বারা আমেরিকাকে মুগ্ধ করলেন। বিশ্বজয়ের পর ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ এলেন লণ্ডনে। মার্গারেট স্বামীজির বক্তৃতা শুনে ভারতীয় দর্শনের প্রতি উত্তরােত্তর আকষ্ট হন। একদিন মার্গারেট স্বামীজিকে তার মনের সংশয়ের কথা বলেন। স্বামীজি তাকে ভারতীয় দর্শন-এর সারতত্ত্ব সরলভাবে বুঝিয়ে দিলেন।বিবেকানন্দের বাণী তাকে মহাজীবনের সন্ধান দিল। খণ্ড ক্ষুদ্রকে বর্জন করে সেই শাশ্বত এক আবনশ্বর ধ্যানে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। গ্রহণ করলেন স্বামীজির শিষ্যত্ব। মার্গারেট বিবেকানন্দের ভিতরে খুঁজে পেলেন তাঁর ধ্যানের গুরুকে। মার্গারেটের ভিতরে বিবেকানন্দ দেখলেন একজন করুণাময়ী শুচিশুভ্র রমণীকে।
ভারতে আগমন : ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্গারেট ইংল্যাণ্ডের নিকট হতে বিদায় নিয়ে ভারতভূমিতে পদার্পণ করলেন। সানন্দে নিজের মস্তকে তুলে নিলেন স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। স্বামীজি এই মহিয়সী নারীর অসাধারণ ত্যাগের স্বীকৃতি দান করে সর্বসমক্ষে সগৌরবে ঘােষণা করলেন – ইংল্যাণ্ড আমাদিগকে এক অমূল্য উপহার দিয়েছে, ভারত কল্যাণে আত্মনিবেদিতা এই নারীত্ব।’ স্বামীজিই মার্গারেটের নূতন নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। ভগিনী’ আখ্যা দিলেন সংঘভ্রাতা সন্ন্যাসীগণ।
কর্মভার গ্রহণ : গুরুর আদেশ শিরােধার্য করে নিবেদিতা এবার অবতীর্ণা হলেন বাস্তব কর্মক্ষেত্রে। কলকাতায় বাগবাজার পল্লির বােস পাড়া অঞ্চলে এক অন্ধকার গৃহের ভিতর বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করলেন নিবেদিতা। অতি কষ্টে কয়েকটি কিশােরীসহ কিছু বেশি সংখ্যক বয়স্কা কন্যা সংগ্রহ করে তিনি বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তাঁর শিক্ষাদানের প্রণালী ছিল অতি সহজ এবং অভিনব। পড়তে বসে মেয়েরা পড়ার চেয়ে বেশি আনন্দ পেত। শুধু পাঠ্যগ্রন্থের পড়া পড়িয়ে নিবেদিতা কর্তব্য শেষ করতেন না। ছাত্রীদের গল্পচ্ছলে উপদেশ দিতেন- হিন্দুর প্রাচীন আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা পােষণ করতে, রামায়ণ-মহাভারত থেকে সীতা, সাবিত্রী, গান্ধারি প্রভৃতি মহিয়সী রমণীদের আখ্যান শুনিয়ে ছাত্রীদের তাদের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তুলতেন। নারীজনােচিত চারুকলার শিক্ষা, আলপনা, সেলাই প্রভৃতির অনুশীলনও নিবেদিতার তত্ত্বাবধানে নিয়মিতভাবে হত।
দেশসেবা : নিবেদিতা ভারতবর্ষকে মনে প্রাণে ভালােবেসে এদেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন। এদেশ ছিল তার স্বদেশ। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দেশে তখন স্বাধীনতার সংগ্রাম চলছে। ফাঁসির মঞ্চে, পুলিশের গুলিতে স্বদেশি বাঙালি যুবকেরা একের পর এক প্রাণ দিচ্ছে। রাজরােষে পতিত পলাতক সংগ্রামীরা অনেকেই নিবেদিতার নিকট ছিলেন অশেষ প্রকারে ঋণী। আন্তরিক সহানুভূতি, অর্থ সাহায্য তিনি অকাতরে বিতরণ করতেন। সাহিত্য-সাধনার মাধ্যমেও এই মহিয়সী মহিলা করে গেছেন ভারতের সেবা। তার রচিত ‘ক্লেডেটেলস্ অব হিন্দুইজম’, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আইসহি প্রভৃতি গ্রন্থে তার ভারত অনুরাগ ও গুরুভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রয়াণ : নিবেদিতা ভারতকে করে নিয়েছিলেন মনে প্রাণে আপন। নিষ্ঠাবতী ব্রহ্মচারিণীর জীবন যাপন করতেন তিনি। আচারে, ব্যবহারে, আহারে কোথাও ছিল না পাশ্চাত্যভাব। ধ্যান-ধারণা জীবন-চর্চায় তিনি ছিলেন খাঁটি ভারতীয়। মা সারদা তাকে সর্বদা নিজের কন্যা বলেই পরিচয় দিতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘লােকমাতা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর ভগিনী নিবেদিতার জীবন দীপ হল নির্বাপিত।
উপসংহারঃ ভগিনী নিবেদিতা নিজ বৈশিষ্ট্যে ভারতাত্মায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতবাসীর তিনি মহিয়সী ভগিনী। তাঁর আত্মত্যাগের আদর্শ চিরদিন ভারতবাসীকে
উদ্বুদ্ধ করবে।