
প্রাক কথা – লেখার টেবিলে একটু ঝিমুনি এসেছিল। হঠাৎ শুনি কে যেন ডাকছে – বৎস জঙ্গল, ঘুম-জড়িত চোখে চেয়ে দেখি, অনতিদূরে আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্ব বরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । তিনি আমাকে বল্লেন, তুমি আমার কিছু কবিতা যুগপোযোগী করে লেখো। আমি বল্লাম, একি গুরুদেব! আপনার কবিতায় আমি হাত দেব ? তিনি বল্লেন, কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এই বৃদ্ধ বয়েসে এতদূর এসে এমনিতেই আমি হাঁপিয়ে উঠেছি, আমাকে বেশি কথা বলিয়ে লাভ নেই। আমি যখন কবিতাগুলো লিখেছিলাম তখনকার দিন আর এখনকার দিন অনেক বদলে গেছে। আমি যে তীর্থ দেখে ভারততীর্থ লিখেছিলাম সে পূণ্যতীর্থ আর নেই, তা আজ শূন্যতীর্থ হয়ে গেছে। আমার নির্দেশ – তুমি লিখে যাও। যদিও আমার খুব কষ্ট হবে, তবুও মাঝে-মাঝে এসে আমি তোমাকে বলে দেব কখন কি লিখতে হবে। নাও এখন শুরু করো । সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। রাত থাকতে থাকতেই আমাকে চলে যেতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি লেখো, আমি বলে যাই। বিনা বাক্যব্যয়ে আমি লিখতে লাগলাম আর তিনি বলে যেতে থাকলেন –
বাংলা প্যারোডি কবিতা শূন্যতীর্থ
কবি – জংগল সিং ঝঞ্ঝাটওয়ালা (মাহতাবুর রহমান)
রচনাকাল – ১৯৯০
হে মোর চিত্ত, শূন্য তীর্থে জাগো রে ফিরে –
এই ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত-নদীতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে গর্দান বাড়ায়ে হেরি যমদূতেরে
নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বে নিরানন্দে থাকতে হয় সবারে ।
রক্তাক্ত এই যে ভূধর নদী লালে লাল লোহিত প্রান্তর
হেথা নিত্য হের উলঙ্গ মৃত্যুরে-
এই ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত নদীতীরে ।।
কেহ নাহি জানে কার গর্দানে কখন পড়বে খাঁড়া;
অতর্কিতে কসাই কোপ দেবে বসাই দাড়া ধৈর্য ধরে দাঁড়া।
হেথা নর ও নারী রক্ষা নেই কার-ই, হেথায় ধনী ও দীন
নিষ্পাপ সকল শিশুর দল, নিমিষে হয় বিলীন ।
রাজনীতি আজ খুলিয়াছে দ্বার, তাই বাড়িয়াছে মৃত্যুর হার
বুলেট আর গুলি, খাঁড়া-তরবারি কখন কার তরে-
এই ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত-নদীতীরে ।।
রণধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদ কলরবে
ঘরে ও বাইরে আছে চারিধারে, আছে তারা ছড়ায়ে সবে
তারা মানুষেরই মাঝে সবাই বিরাজে কেহ নহে নহে দূর
মানুষ মারিতে আঁধার রাতিতে তারা সাজে চোর ।
হে মৃত্যুবীণা, বাজো বাজো বাজো, মরেনি যারা আজো
তারাও মরিবে কেহ না রহিবে মৃত্যু রবে তাদেরে ঘিরে –
এই ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত-নদীতীরে ।।
যেথা একদিন বিরামবিহীন উঠেছিল ঐক্যের করতালি
সেথা আজ খালিস্থান করিতে মানুষ মারি করিছে খালি ।
অস্ত্রের বলে সেই ক্রোধানলে বহুরে আহুতি দিয়া
বিভেদ গড়িল জাগায়ে তুলিল এক আতঙ্কিত হিয়া
[সেই] মানুষ বধিবার কসাইখানার খোলা আজি দ্বার
সেথা সবারে হবে মিলিবারে অপমৃত্যুর পরে –
এই ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত-নদীতীরে ।।
সেই হিংসানলে হের আজি জ্বলে দুঃখের বহ্নিশিখা
হবে তা সহিতে মর্মে দহিতে আছে সে ভাগ্যে লিখা ।
এ দুঃখ বহন কর মোর মন শোনরে মৃত্যুর ডাক,
যত মৃত্যুভর করো করো জয় সব লালে লাল হয়ে যাক।
দুঃসহ ব্যথা হবে অবসান, জন্ম লভিবে শ্মশান-গোরস্থান
আসিছে রজনী জাগিছে জননী শিশু লয়ে ক্রোড়ে –
এই ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত-নদীতীরে
এসো হে সি আর পি, এসো হে পুলিশ, এসো সেনাবাহিনী
এসো এসো বালক, এসো নাবালক এসো আবালবৃদ্ধভগিনী ।
মরো আর মারো যে যত পারো এ মারণে সবার সমঅধিকার
এসো গভর্ণার, এসো এসো সরকার, আজ তোমারও যে দরকার
এসো এম এল এ মন্ত্রীগণ করি হত্যার পণ ধরো টুটি টিপে জনতার
মৃত্যুর অভিষেকে এসো এসো ত্বরা,
রক্তে নদী হয়নি যে ভরা
আশি কোটি মানুষ-মেষের শোণিত-নদীতীরে-
আজি ভারতের নিরীহ মানুষের রক্ত-সাগরপারে ।।
Leave a comment