কবিতা সম্বন্ধে:
“চিত্ত যেথা ভয় শূণ্য” রবীন্দ্রনাথের একটি বহু আলোচিত এবং জনপ্রিয় কবিতা। মূলত কবিতাটি ১৯১০ সালে প্রার্থনা নামে প্রকাশ পায় এবং রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রেন্থ সংযুক্ত করা হয়।
মূলভাব:
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্ব লিখিত এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক স্বাধীনতার ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতার আবশ্যকতা এবং সার্থকতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভারত এবং ভারতীয়দের কে জাগ্রত হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বলা যায় রবীন্দ্রনাথ তার স্বাধীনতার ভাষ্য কে এই কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নয় এই কথা স্পষ্টভাবে এই কবিতার মধ্যে ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের মতে স্বাধীনতা যে শুধুমাত্র ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্তি, তা ছিল না বরং তাঁর স্বাধীনতার পরিধি বা কল্পনা ছিল ব্যাপক। স্বাধীনতা শুধুমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তর নয় বরং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, জ্ঞানের স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা সমভাবে একটি জাতির জন্য প্রয়োজনীয় এই কথাগুলি এই কবিতায় পরিলক্ষিত হয়েছে।
সারাংশ:
স্বাধীনতা বলতে যেখানে চিত্ত ভয় শূন্য হবে অর্থাৎ মানুষের মধ্যে কোন ভয় থাকবে না। যেথা মানুষ তার মাথা উঁচু করে সম্মানের সহিত বেঁচে থাকবে, যেখানে জ্ঞান হবে উম্মুক্ত, জ্ঞান হবে সবার তাতে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ।
স্বাধীনতা সেখানেই থাকবে যেখানে মানুষ ভেদাভেদ ছাড়া বসবাস করবে একত্রে। যেখানে ধনী-দরিদ্র বলে কোন সীমারেখা থাকবে না। সেখানেই স্বাধীনতা সম্ভব।
স্বাধীনতা সেখানেই থাকবে যেখানে মানুষ তার হৃদয়ের কথা বলবে নির্দ্বিধায়। অর্থাৎ যেখানে হৃদয় থেকে সত্য উচ্ছাসিত হবে। কারণ সততাই উত্তম পন্থা তাই যেখানে সত্য সেখানে স্বাধীনতা। তৎসঙ্গে তিনি এমন একটি স্বাধীন ভারতবর্ষের কল্পনা করেছেন যেখানে মানুষের কর্মধারা অবাধ স্রোতের মত দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ তাহাদের কর্মধারা আটকা পড়বে না রাজনৈতিক গন্ডির ভিতরে। স্বাধীনতা সেখানেই থাকবে যেখানে মানুষের সাফল্যের প্রচেষ্টা বা তাদের কর্মধারা কোন রাজনৈতিক বেড়াজালে আটকা পড়বে না।
কবি স্বাধীনতার কল্পনা সেখানে করেছেন যেখানে তুচ্ছ আচার-আচরণ, অযৌক্তিক প্রথা ও রীতি নীতি দিয়ে জ্ঞান ও বিচার আটকে দেওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ স্বাধীনতা সেখানেই থাকবে যেখানে যুক্তি ও জ্ঞান কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাসের কাছে হেরে যাবে না।
তাই কবি সর্বোপরি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন যেন ঈশ্বর তার নিজ হস্তে ভারতবর্ষকে সেই রকম একটি মুক্ত দেশে পরিণত করেন। যে ভারত বর্ষ মুক্ত হবে ভেদাভেদ, উচ্চ নীচ, মিথ্যা, অত্যাচার, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস থেকে। আর তখনই ভারত হয়ে উঠবে স্বর্গরাজ্যে।

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
Chitto Jetha Bhayshunyo Meaning in Bengali
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়–
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা–
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
শব্দার্থ:
- চিত্ত- মন,প্রান
- শির- মাথা
- প্রাচীর- দেওয়াল
- প্রাঙ্গণতলে- অঙ্গন, উঠান
- দিবসশর্বরী- দিন-রাত্রে, অর্থাৎ কখনই
- বসুধারে- পৃথিবীতে অর্থাৎ তাঁর বাস করার স্থান
- উৎসমুখ- উৎপত্তিস্থান
- উচ্ছ্বসিয়া- আবেগে আকুল হইয়া
- নির্বারিত- অবারিত, অবাধ
- কর্মধারা- কাজ, কাজের গতি, কাজের ধরন
- চরিতার্থতায়- কৃতকার্য, সফলকাম, সিদ্ধমনোরথ
- তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি- অর্থাৎ অবাঞ্ছিত আচার আচরণ বা অযৌক্তিক প্রথা ও রীতি নীতি ইতাদি বুঝানো হয়েছে।
- স্রোতঃপথ- প্রবাহ, ধারা। এখানে বিচারের, বুদ্ধির বা জ্ঞানের ধারা কে বুঝানো হয়েছে।
- গ্রাসি-গ্রাস করা, ধ্বংস সাধন
- শতধা- শতবার
- তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা- ঈশ্বর সব কর্ম চিন্তা ও আনন্দের নেতা অর্থাৎ ঈশ্বর সর্বোপরি
- পিতঃ পিতা
To Read The Summary of the poem Where the mind is without fear in English Click here
1 Comment