রচনাঃ একটি নদীর আত্মকথা | Autobiography of a river in Bengali
Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.
জিজ্ঞেস করুন আপনার যে কোনো প্রশ্ন আর যুক্ত থাকুন সবসময়
Create A New Account
Hridoy
একটি নদীর আত্মকথা
আমি তোমাদের চির চেনা একটি নদী-আমার নাম ‘গঙ্গা’। গঙ্গা নামটি আমার কাছে অনেক প্রিয়। আমাকে জটায় লুকিয়ে রেখে শিব ‘গঙ্গাধর’ নাম পেয়েছেন। আমার পক্ষে এটা কম গৌরবের কথা নয়। তবে দুঃখ হয়— ত্রিলোকেশ্বরের মাথায় উঠে কত না চঞ্চলতা করেছি—কত না পাপ হয়েছে তাতে। আমার অপর একটা নাম জাহ্নবী। তবে এই নামটা আমার তেমন পছন্দের নয়। একটু ছেলেমানুষী করেছিলাম বলে রাক্ষুসে মুনি আমায় গিলে ফেলেছিল।
ঠিক কোন্ কালে জ্ঞানের উন্মেষ হয় তা যেমন তোমাদের কাছে অজানা তেমনি আমারও জানা নেই। এখন ঠিক করে বলা অসম্ভব কবে, কেমন করে আমি বড় হয়ে তােমাদের মাঝখানে এসে পড়েছি, আর কি ক’রেই বা তােমাদের কাছে এত পরিচিত হ’য়েছি। তবে শৈশবের স্মৃতি মনের কোণে মাঝে মাঝে অম্পষ্ট হ’য়ে ফুটে ওঠে। মনে হয় কত যুগ আগে আমি যেন কোন তুষারের রাজ্যে একা একা আপন মনে ঘুরে বেড়াতাম ; শীতের দিনে কুঁকড়ে কুঁকুড়ে চলাফেরা করতাম, কখনও বা একটু আধটু খেলা করবার লােভ হতো। যখন একটু গরম পড়তাে তখন একটু একটু করে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতাম সামনে কি আছে দেখবো বলে; বাহির বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার মনে জেগে ওঠে। কিন্তু বড় বড় পাহাড়গুলাে পথ রােধ করে দাড়িয়ে ধমক দিয়ে বলতাে-অতটুকু মেয়ে যাচ্ছ কোথা? ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াতাম, কিন্তু বহির্জগতের বিরাট জীবনধারার বিচিত্র কোলাহল আমাকে অবিরত আহ্বান করতাে। তাই পাহাড়গুলাের পাশ কাটিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে যাবারই চেষ্টা করতাম।
অবশেষে সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একদিন বুঝলাম আমার শক্তি সহস্রগুণ বেড়ে গেছে। শুধু এইটাই বুঝতে পারি না কতদিন আমি সেই তুষারের দেশে কাটিয়েছি আর ঠিক কোন দিনটিতে কেমন করে আমি শক্তির প্রাচুর্য্যে ছুটুতে স্থরু করেছি তােমাদের দিকে। তােমরা বল ভগিরথ তপস্যা করে আমায় নিয়ে এসেছেন কিন্তু আমার তাে মনে হয় আমারই তপস্যায় তুষ্ট হ’য়ে কোন মহাপুরুষ হঠাৎ একদিন আমাকে পাষাণকারা চুর্ণ করে উদ্দামবেগে ছুটে চলবার শক্তি দিয়েছিলেন। যাই হােক তখনকার সে উত্তেজনা জীবনে কোন দিন ভুলবো না। কত বাধা এল, কিন্তু কেউ সেদিন আমার সামনে দাড়াতে পারলাে না। বড় বড় পাহাড়গুলােকে ধাক্কা মেরে তাদের মাথায় পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চললাম, আমার মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে লাগলাে, চুলগুলাে পিছন দিকে উড়তে লাগলাে। তবু আমার শ্রান্তি এল না, এতটুকু বিচলিত হলাম না। ছােট ছােট গাছ আর লতাগুলাের কি স্পর্ধা! তারা চাইল আমার পথ রােধ করতে। বেচারীদের দুর্ভাগ্যের কথা আর কি বলব।দেশ ছাড়া হয়ে পাক খেতে খেতে আমার সঙ্গে তারা ছুটতে থাকলা। যা পায় সামনে তাই ধ’রে বাঁচতে চায় কিন্তু তাদের কোথাও দাড়াতে না দিয়ে টেনে নিয়ে ছুটলাম।
যেদিন তােমাদের মাঝখানে এসে দাড়ালাম, সেইদিন কেন জানি না, আমি কেমন একরকম হয়ে গেলাম। মনে এই প্রশ্নের উদয় হলে জীবন কি? কিসের জন্য আমার জন্ম? কিসের জন্য সংসারে আমার অস্তিত্ব? স্তির হয়ে ভাবলাম-ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেছি এমন সময় শুনতে পেলাম নিখিল বিশ্ব যেন সঙ্গীতের ঝংকারে বলে উঠলা – বেঁচে থাকা পরের জন্য, জীবের সেবা জন্যই অস্তিত্ব; পরোপকারে যে জীবন উৎসর্গ করতে পারে, জীবনান্তে বিশ্বপতির ক্রোড়ে সেই স্থান পায়। সেদিন থেকেই আমার পরিবর্তন হয়েছে, আমার ভীষণতা দূর হয়েছে। সেদিন থেকেই আমি ছু’হাতে তােমাদের অন্য বিতরণের চেষ্টা করে এসেছি। জানি না—অসীমের বুকে আমার স্থান হবে কিনা।