একটি বট গাছের আত্মকথা আমি বহু পুরানো এক বটগাছ। হাওর জনপদ নাহাটিয়া উপজেলা সদরের ২ কিলােমিটার উত্তরে ভয়রা গ্রামে আমার বাস । এক সময় আমার চারপাশের গ্রাম গঞ্জে আমার বেশ কিছু সাথী ছিল। কিন্তু স্বার্থপর, লোভী এবং উদ্বেগহীন মানুষেরা আমার সেই জাত ভাইদেরকে ধ্বংস করেছে। বর্তমানে আমি একা নিঃসঙ্গ অবস্থায় গ্রাRead more
একটি বট গাছের আত্মকথা
আমি বহু পুরানো এক বটগাছ। হাওর জনপদ নাহাটিয়া উপজেলা সদরের ২ কিলােমিটার উত্তরে ভয়রা গ্রামে আমার বাস । এক সময় আমার চারপাশের গ্রাম গঞ্জে আমার বেশ কিছু সাথী ছিল। কিন্তু স্বার্থপর, লোভী এবং উদ্বেগহীন মানুষেরা আমার সেই জাত ভাইদেরকে ধ্বংস করেছে। বর্তমানে আমি একা নিঃসঙ্গ অবস্থায় গ্রামের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর দিন গুনছি। কবে যে আমার জন্ম হয়েছিল তা আমার জানা নেই। তবে আমি মহাকালের বহু ঘটনার নীরব সাক্ষী। আমি প্রত্যক্ষ করেছি অনেক দুর্যুগ, মহামারি আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
আমি আমার জীবনে অনেক উত্থান-পতন পেরিয়েছি।গ্রামের অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি । জন্ম, মৃত্যু, পূজা পার্বনে সবাই আমাকে স্মরণ করেছে। পুরো গ্রাম আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে এবং আমাকে পরিবারের একজন বয়স্ক সদস্য হিসাবে মনে করে। আমার ছত্র ছায়ায় বসে হয়েছে অনেক মিটিং মিছিল।গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ছোটোখাটো আলোচনা আমার প্রাঙ্গনে হয়েছে উন্নত কাল ধরে।
আমার পাশে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছােট ছােট ছেলে মেয়েরা নানান রঙ্গের জামা কাপড় পড়ে লেখা পড়ার পাশাপাশি যখন খেলা-ধুলায় মত্ত হয় আমার তখন খুব ভাল লাগে। আমি পরম মমতায় তাদের ছায়া দেই এবং শাখা দোলিয়ে বাতাস করি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রথম ক্লাশ শুরুর আগে আমি মুগ্ধ বিষ্ময়ে শুনলাম অপূর্ব এক সংগীত “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি”। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই প্রাণ জোড়ানাে সংগীতে আমার নামও উচ্চারিত হয়। এ যে, আমার কাছে অক্ষয় রাজতিলক। দরদ ভরা কণ্ঠে প্রতিদিন এই সংগীত শুনে শুনে আমার হৃদয়ের ক্ষত শুকিয়ে যায়। আমি নতুন করে সজিব হয়ে উঠি। ঈদ এবং পূজার ছুটিতে আমি বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। তখন পুরােনু স্মৃতিগুলি আমার মনে একে একে উদয় হতে থাকে।
আমার সুন্দর পরিবেশটি নষ্ট করে চারপাশে গড়ে ওঠেছে অবৈধ জনবসতি। নিজের অস্থিত্বকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য আমি সহস্র শিকড় দিয়ে মাটিকে আঁকড়ে মােকাবিলা করতে পেরেছি বহু প্রলয়ংকারী ঝড় ও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু মানুষের দখলদারিত্ব রুখবার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা তােমাদের যদি থাকে তবে আমার দুঃখ নেই। প্রকৃতির অমােঘ বিধানে মরতে তাে একদিন হবেই! তবে তােমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমি। শুধুমাত্র একটি বটবৃক্ষ নই। আমি তােমাদের ইতিহাসের সাক্ষী। আমি বিশাল হাওর অঞ্চলের বৃহত্তম বধ্যভূমি।
See less
Hridoy
একটি নদীর আত্মকথা আমি তোমাদের চির চেনা একটি নদী-আমার নাম 'গঙ্গা'। গঙ্গা নামটি আমার কাছে অনেক প্রিয়। আমাকে জটায় লুকিয়ে রেখে শিব 'গঙ্গাধর' নাম পেয়েছেন। আমার পক্ষে এটা কম গৌরবের কথা নয়। তবে দুঃখ হয়— ত্রিলোকেশ্বরের মাথায় উঠে কত না চঞ্চলতা করেছি—কত না পাপ হয়েছে তাতে। আমার অপর একটা নাম জাহ্নবী। তবেRead more
একটি নদীর আত্মকথা
আমি তোমাদের চির চেনা একটি নদী-আমার নাম ‘গঙ্গা’। গঙ্গা নামটি আমার কাছে অনেক প্রিয়। আমাকে জটায় লুকিয়ে রেখে শিব ‘গঙ্গাধর’ নাম পেয়েছেন। আমার পক্ষে এটা কম গৌরবের কথা নয়। তবে দুঃখ হয়— ত্রিলোকেশ্বরের মাথায় উঠে কত না চঞ্চলতা করেছি—কত না পাপ হয়েছে তাতে। আমার অপর একটা নাম জাহ্নবী। তবে এই নামটা আমার তেমন পছন্দের নয়। একটু ছেলেমানুষী করেছিলাম বলে রাক্ষুসে মুনি আমায় গিলে ফেলেছিল।
ঠিক কোন্ কালে জ্ঞানের উন্মেষ হয় তা যেমন তোমাদের কাছে অজানা তেমনি আমারও জানা নেই। এখন ঠিক করে বলা অসম্ভব কবে, কেমন করে আমি বড় হয়ে তােমাদের মাঝখানে এসে পড়েছি, আর কি ক’রেই বা তােমাদের কাছে এত পরিচিত হ’য়েছি। তবে শৈশবের স্মৃতি মনের কোণে মাঝে মাঝে অম্পষ্ট হ’য়ে ফুটে ওঠে। মনে হয় কত যুগ আগে আমি যেন কোন তুষারের রাজ্যে একা একা আপন মনে ঘুরে বেড়াতাম ; শীতের দিনে কুঁকড়ে কুঁকুড়ে চলাফেরা করতাম, কখনও বা একটু আধটু খেলা করবার লােভ হতো। যখন একটু গরম পড়তাে তখন একটু একটু করে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতাম সামনে কি আছে দেখবো বলে; বাহির বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার মনে জেগে ওঠে। কিন্তু বড় বড় পাহাড়গুলাে পথ রােধ করে দাড়িয়ে ধমক দিয়ে বলতাে-অতটুকু মেয়ে যাচ্ছ কোথা? ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াতাম, কিন্তু বহির্জগতের বিরাট জীবনধারার বিচিত্র কোলাহল আমাকে অবিরত আহ্বান করতাে। তাই পাহাড়গুলাের পাশ কাটিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে যাবারই চেষ্টা করতাম।
অবশেষে সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একদিন বুঝলাম আমার শক্তি সহস্রগুণ বেড়ে গেছে। শুধু এইটাই বুঝতে পারি না কতদিন আমি সেই তুষারের দেশে কাটিয়েছি আর ঠিক কোন দিনটিতে কেমন করে আমি শক্তির প্রাচুর্য্যে ছুটুতে স্থরু করেছি তােমাদের দিকে। তােমরা বল ভগিরথ তপস্যা করে আমায় নিয়ে এসেছেন কিন্তু আমার তাে মনে হয় আমারই তপস্যায় তুষ্ট হ’য়ে কোন মহাপুরুষ হঠাৎ একদিন আমাকে পাষাণকারা চুর্ণ করে উদ্দামবেগে ছুটে চলবার শক্তি দিয়েছিলেন। যাই হােক তখনকার সে উত্তেজনা জীবনে কোন দিন ভুলবো না। কত বাধা এল, কিন্তু কেউ সেদিন আমার সামনে দাড়াতে পারলাে না। বড় বড় পাহাড়গুলােকে ধাক্কা মেরে তাদের মাথায় পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চললাম, আমার মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে লাগলাে, চুলগুলাে পিছন দিকে উড়তে লাগলাে। তবু আমার শ্রান্তি এল না, এতটুকু বিচলিত হলাম না। ছােট ছােট গাছ আর লতাগুলাের কি স্পর্ধা! তারা চাইল আমার পথ রােধ করতে। বেচারীদের দুর্ভাগ্যের কথা আর কি বলব।দেশ ছাড়া হয়ে পাক খেতে খেতে আমার সঙ্গে তারা ছুটতে থাকলা। যা পায় সামনে তাই ধ’রে বাঁচতে চায় কিন্তু তাদের কোথাও দাড়াতে না দিয়ে টেনে নিয়ে ছুটলাম।
যেদিন তােমাদের মাঝখানে এসে দাড়ালাম, সেইদিন কেন জানি না, আমি কেমন একরকম হয়ে গেলাম। মনে এই প্রশ্নের উদয় হলে জীবন কি? কিসের জন্য আমার জন্ম? কিসের জন্য সংসারে আমার অস্তিত্ব? স্তির হয়ে ভাবলাম-ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেছি এমন সময় শুনতে পেলাম নিখিল বিশ্ব যেন সঙ্গীতের ঝংকারে বলে উঠলা – বেঁচে থাকা পরের জন্য, জীবের সেবা জন্যই অস্তিত্ব; পরোপকারে যে জীবন উৎসর্গ করতে পারে, জীবনান্তে বিশ্বপতির ক্রোড়ে সেই স্থান পায়। সেদিন থেকেই আমার পরিবর্তন হয়েছে, আমার ভীষণতা দূর হয়েছে। সেদিন থেকেই আমি ছু’হাতে তােমাদের অন্য বিতরণের চেষ্টা করে এসেছি। জানি না—অসীমের বুকে আমার স্থান হবে কিনা।
See less