কবিতা সম্বন্ধেঃ
মধুসূদন দত্ত রচিত ‘বঙ্গভাষা’ কবিতাটি ‘চতুর্দশপদী-কবিতাবলী’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে অবস্থানকালে ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সনেট রচনায় ব্রতী হন, এই রচনাসমূহ ‘চতুর্দশপদী-কবিতাবলী’ গ্রন্থে সংকলিত হয়ে ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তবে আলােচ্য কবিতাটি প্রথমে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাসে কবিমাতৃভাষা’ নামে লিখিত হয়েছিল, এটি পুণর্লিখিত হয়ে বঙ্গভাষা’ নামে উক্ত গ্রন্থভুক্ত হয়।
সারমর্মঃ
বাংলা ভাষার সাহিত্যভান্ডার বিচিত্র সম্পদে পরিপূর্ণ, কিন্তু কবি সেসব বৈভবকে অবহেলা করে নির্বোধের মত পরের সম্পদ আহরণে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন; অর্থাৎ পাশ্চাত্য সাহিত্যচর্চার জগতে পরিভ্রমণের ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। এ ছিল কবির জীবনের এক অনভিপ্রেত সময়, বিফল সাধনায় মগ্ন থাকার মরীচিকা মাত্র। কারণ পরভাষায় বড় কবি হওয়ার প্রয়াস ব্যর্থতাই বয়ে আনে। পদ্মবনের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য পরিত্যাগ করে তিনি শ্যাওলা নিয়ে ক্রীড়ামত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মাতৃভাষার অধিষ্ঠাত্রী দেবী স্বপ্নাদেশে কবির চেতনা জাগ্রত করেন, অর্থাৎ কাব্যচর্চার প্রেরণা অনুভব করে তিনি বাংলাভাষায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই ভাষা কবির মাতৃভাষা—অজস্র মণিমাণিক্যে পরিপূর্ণ, অতএব পরভাষা আহরণে ভিক্ষা প্রার্থনার কোন যুক্তি নেই। কাব্যলক্ষ্মীর আহ্বানে কবি সুখানুভবে ও আত্মমর্যাদায় ঋদ্ধ হয়ে মাতৃভাষায় খুঁজে পান অনন্ত রত্নসম্পদের আকর এবং বাংলা সাহিত্যকে নিজ প্রতিভার স্পর্শে সমৃদ্ধ করেন।
ব্যাখ্যা ও বিষয়বস্তুঃ
‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় বিধৃত হয়েছে এই আত্মস্বাক্ষরিত ও সচেতন অন্তলোকের উদ্ভাস। বাংলাভাষার ঐশ্বর্যের প্রতি প্রিয় সম্ভাষণ ও শ্রদ্ধাবােধে কবিতাটি অনন্য। এখানে আরাে উন্মােচিত হয়েছে ভিন্নভাষা ও সংস্কৃতিতে লিপ্ত থাকার ভ্রান্তি থেকে মুক্তির আনন্দ। কবিচিত্তে জেগেছে মাতৃভাষা-প্রীতি ও সচেতনতা, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অন্তর্নিহিত আবেগ এবং সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে গভীর আত্মবিশ্বাস। একে বলা যায় অন্ধকার চিত্তগুহায় সূর্যালােকের স্পর্শলাভ এবং মাতৃভাষায় ঐতিহ্যরূপ বিশাল রত্নখনির আবিষ্কার। কবির এই আবিষ্কার ও প্রত্যাবর্তনই পরবর্তীকালে তাকে অভিষিক্ত করেছে বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র হিসেবে।
বঙ্গভাষা’ কবিতাটি মধুসূদনের কবিসত্তার বন্ধনমােচন ও বিকাশের সংহত শিল্পভাষ্য। এতে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষা বিষয়ক অনুভূতির চিরায়ত প্রকাশ, পরবর্তীকালের আরও অনেক ভাষা বিষয়ক কবিতার মমতাঘন ও সংকল্প-শুদ্ধ রূপের পূর্বাভাস। আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাপুত সংগ্রাম ও আবেগ-আর্তির যে মহত্তম ইতিহাস রয়েছে, কবিতাটি যেন তারই বীজাঙ্কুর।
Leave a comment