ভূমিকা : জলের অপর নাম জীবন। জল ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। অথচ প্রকৃতির এমনই পরিহাস যে এই জলই আবার অপ্রত্যাশিতভাবে মানুষের জীবনে ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়ায়। সহস্র নাগিনীর মতাে ফণাতুলে ধেয়ে আসে জলের তরঙ্গমালা। তখনই বােঝা যায় আজও মানুষ প্রাকৃতিক শক্তির কাছে কত অসহায়। বন্যা এমনি এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ভারতমাতার বড় আদরের কন্যা রূপ লাবণ্যময়ী এই অসমের বন্যা জনিত দুঃখ প্রতি বছরের এক অভিশাপ।
আসামের বন্যার প্রাকৃতিক কারণ : আসাম নদীমাতৃক দেশ। এ দেশ ভারতবর্ষের মধ্যে চতুর্দিকে পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত একটি রাজ্য। এ রাজ্যে বন্যার প্রধান কারণ হলাে মহাবাহু দীর্ঘতম নদ ব্রহ্মপুত্র। একদা চীনদেশের হােয়াংহাে নদ যেমন ছিল চিনের দুঃখ, আসামের ব্রহ্মপুত্র নদের বেলায়ও আজকাল এরূপ বলা যায়। ১৯৫০ – সনের ভূমিকম্পের পর থেকে আসামে প্রায় প্রতি বছর প্রবল বন্যার আবির্ভাব ঘটে। বােধ হয় ভূমিকম্পের ফলে নদীখাত উপরে উঠে আসায় নদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে, তাই অল্প জল জমলেও তীর ভূমি প্লাবিত হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদ আসামের উত্তর পূর্ব সীমান্ত বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে লােহিত নামে আসামে প্রবেশ করেছে। উত্তর পূর্ব সীমান্তের পর্বত শ্রেণিতে প্রচুর পরিমাণে তুষার সঞ্চিত হয়, বৃষ্টির জলের সঙ্গে গলিত এ তুষার স্থপ আসামের নদীগুলির সাথে মিশ্রিত হয়। আবার মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আসামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অধিক।অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীগুলি ফুলে ফেঁপে উভয় তীর প্লাবিত করে সৃষ্টি করে বন্যার।
আসামে বন্যার কৃত্রিম কারণ : আসামের পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষ জমচাষের জন্য বনজঙ্গল আর গাছপালা অনবরত কেটে চলছে। এর ফলে বর্ষার সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতে এসব অঞ্চলে ভূমিক্ষয় হয়ে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মত্তিকা ফলে দিন দিন নদী গর্ভগুলি কৃত্রিমভাবে ভরে উঠেছে। আর নদীর স্বাভাবিক খরোস্রোতা হচ্ছে নষ্ট। এভাবে নদীর উপর উচু হয়ে জল ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে বন্যার। এভাবে দেখা যাচ্ছে বর্ষার আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত পাঁচবার বন্যা এসে জনজীবন বিপর্যস্ত করছে।
বন্যার অতর্কিতে আবির্ভাব : বর্ষাকালে সাধারণত অতি বৃষ্টির ফলে জল ফুলে ফেপে তার শাখা নদীগুলিকে স্ফীত করে উপচিয়ে পড়ে। কখনও নদী বাধ’ বা স্থানে স্থানে বাঁধ ডিঙিয়ে প্রচণ্ড বেগে জনপদ আর শস্যক্ষেত্র গ্রাস করে যেন মায়াবী অজগর ভাঙ্গা বাঁধের সরুপথে গলে বের হয়ে ছুটছে আর ভয়ঙ্করভাবে সে দুর্নিবার বেগে সরু দেহখানিকে বিস্তার করছে, সম্মুখে যা পড়ছে তা-ই এ অজগর গ্রাস করে নিচ্ছে। এভাবে বাঁধ ভেঙ্গে ঘরবাড়ি, গ্রাম, প্রান্তর ভাসিয়ে মুহুর্তে সব একাকার করে দেয়। মানুষকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার সুযােগ দেয় না। এভাবে অতর্কিতে আবির্ভাব হয় বন্যার।
বন্যার ভয়াবহ রূপ : মানুষের বহুদিনের বহু কষ্টে সাজানাে ঘরদোর জলাঞ্জলি দিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা তখন পালানাের পথ পায় না। কাছে উচু টিলা বা উচু জায়গা, পাকা বাড়ির ছাদ, উঁচু সরকারি কার্যালয় যেখানে পারে সেখানেই আশ্রয় লওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়। শিশু ও বৃদ্ধ আর গরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর প্রভৃতির অধিকাংশ তখন রক্ষা পায় না। জলের তীব্রবেগে গাছ, বাঁশঝাড় উপড়িয়ে ঘর ভেঙ্গে ভেসে নিয়ে চলে। দিগন্ত • জুড়ে একটা সাগর যেন অনন্ত ক্ষুধায় হাঁ করে আসছে। যেদিকে যতটুকু তাকানাে যায়কবির ভাষায় –
‘জল আর শুধ
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল ।
খল জল ছলভরা তুমি লক্ষ ফণা
ফুসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা।
মৃত্তিকার শিশুদের লালায়িত মুখ।
এভাবে এক একটা অঞ্চল ধুইয়ে মুছে বন্যার গর্ভে লীন হয়ে যায়। মানুষ চোখের সম্মুখে দেখতে পায় ঈশ্বরের রুদ্র মহিমা। বন্যার ফলে যে শুধু বন্যা দুর্গত অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাই নয়, সমগ্র রাজ্যেই এর প্রভাব অনুভূত হয়।
বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জেলাগুলি : ভৌগােলিক মানদণ্ডে আসামের সমস্ত ভূ-খণ্ডকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা – (১) ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও (২) বরাক উপত্যকা। বর্ষার আরম্ভেই এ দুটি এলাকার ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদী এবং তাদের উপনদীগুলি প্রলয়ঙ্করী রূপ নেয়। এর ফলে ব্ৰহ্মপত্র ও তার উপনদীগুলির দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় উজান আসামের ধেমাজি, ডিব্ৰুগড়, তিনসুকিয়া, উত্তর লক্ষীমপুর আর নিম্ন আসামের গােয়ালপাড়া; ধুবড়ী, বরপেটা প্রভৃতি জিলা। আবার বরাক ও তার উপনদীগুলির দ্বারা কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি প্রভৃতি জেলায় হাহাকার সৃষ্টি হয়।
বন্যার জল নেমে যাওয়ার পরবর্তী অবস্থা ? যাই হােক, মানুষ সামাজিক জীব। তাই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে একে অন্যের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, এগিয়ে আসে অনেক স্বেচ্ছাচারী সংগঠন।
জীবনে যেভাবে কোন দুঃখই চিরস্থায়ী নয়। তাই এ জল-প্লাবনও ধীরে ধীরে কমতে থাকে তখন গ্রাম জাগে কিন্তু কি এক কদর্য রূপধারণ করে চারদিকে পচা দুর্গন্ধ। শস্যক্ষেত্র বিধ্বস্ত, নষ্ট হয়েছে ফসল, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে ঘরবাড়ি। প্রতিটি জেলায়ই মৃত্যুর সংবাদ। সড়ক ও টেলিযােগাযােগ, জল-বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
বন্যার উপকার : বন্যা যে শুধু অনিষ্ট সাধন বা ধ্বংস করে তা নয়। বন্যার ফলে পাহাড়-পর্বত হতে আনিত পলিমাটির দ্বারা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। বাঁধভেঙ্গে জলের সঙ্গে পলিমাটি এসে বড় বড় মাঠের শষ্যক্ষেতের উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া শহর বন্দরের আবর্জনা ধুইয়ে প্রকৃতি নির্মল করে। গাছ-পালা, ফসল সবুজে সবুজ হয়ে উঠে।
প্রতিকারের ব্যবস্থা : ব্ৰহ্মপুত্ৰ বন্যা-নিয়ন্ত্রণ আয়ােগ গঠিত হলেও এ বিষয়ে কিছুই কাজ হয়নি। আসাম সরকার নিজস্ব উদ্যোগে নদীগুলির বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেবার ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুতরাং যে সব নদীতে প্রতি বৎসর বন্যা দেখা দেয় সেসব নদীর কয়েকটি উপধারা সৃষ্টির প্রয়ােজন। তাছাড়া বড় বড় নদীগুলির কাছাকাছি যে সকল ছােট ছােট নদী আছে তাদের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করে জলের স্রোতের দিক পরিবর্তন করে বন্যার বেগ কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বাঁধগুলিকে চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে যেভাবে বৈজ্ঞানিক সম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে আসামের নদীগুলির বাঁধগুলিও সেভাবে তৈয়ার করা প্রয়ােজন। পাহাড়ের জল বৃহৎ জলাধারে সঞ্চিত রেখে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে বরাকের ‘টিপাইমুখ’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বরাক উপত্যকার বন্যা বহুলাংশে কমানাে সম্ভব। উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী অঞ্চলের জুম চাষ বন্ধ করা একান্ত প্রয়ােজন। বিকল্প ব্যবস্থা দ্বারা নদীগর্ভ খনন করানাে উচিত। তাহলে নদীর জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে। এ কাজগুলি আসাম সরকারের অবশ্যই কর্তব্য।
উপসংহার : গ্রহান্তরে পাড়ি জমালেও মানুষ আজও প্রকৃতির হাতে অসহায় । আসামের ভয়াবহ বন্যা মাঝে মাঝে আমাদের একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবুও ঈশ্বরের উপর ভরসা রেখে এ আশা প্রকাশ করা চলে যে আসামের জনজীবন একদিন বন্যার অভিশাপ হতে অবশ্যই মুক্ত হবে।
Nibedita Paul
অসমের বন্যা ও তার প্রতিকার
ভূমিকা : জলের অপর নাম জীবন। জল ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। অথচ প্রকৃতির এমনই পরিহাস যে এই জলই আবার অপ্রত্যাশিতভাবে মানুষের জীবনে ধ্বংসের কারণ হয়ে দাড়ায়। সহস্র নাগিনীর মতাে ফণাতুলে ধেয়ে আসে জলের তরঙ্গমালা। তখনই বােঝা যায় আজও মানুষ প্রাকৃতিক শক্তির কাছে কত অসহায়। বন্যা এমনি এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ভারতমাতার বড় আদরের কন্যা রূপ লাবণ্যময়ী এই অসমের বন্যা জনিত দুঃখ প্রতি বছরের এক অভিশাপ।
আসামের বন্যার প্রাকৃতিক কারণ : আসাম নদীমাতৃক দেশ। এ দেশ ভারতবর্ষের মধ্যে চতুর্দিকে পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত একটি রাজ্য। এ রাজ্যে বন্যার প্রধান কারণ হলাে মহাবাহু দীর্ঘতম নদ ব্রহ্মপুত্র। একদা চীনদেশের হােয়াংহাে নদ যেমন ছিল চিনের দুঃখ, আসামের ব্রহ্মপুত্র নদের বেলায়ও আজকাল এরূপ বলা যায়। ১৯৫০ – সনের ভূমিকম্পের পর থেকে আসামে প্রায় প্রতি বছর প্রবল বন্যার আবির্ভাব ঘটে। বােধ হয় ভূমিকম্পের ফলে নদীখাত উপরে উঠে আসায় নদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে, তাই অল্প জল জমলেও তীর ভূমি প্লাবিত হয়।
ব্রহ্মপুত্র নদ আসামের উত্তর পূর্ব সীমান্ত বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ দিয়ে লােহিত নামে আসামে প্রবেশ করেছে। উত্তর পূর্ব সীমান্তের পর্বত শ্রেণিতে প্রচুর পরিমাণে তুষার সঞ্চিত হয়, বৃষ্টির জলের সঙ্গে গলিত এ তুষার স্থপ আসামের নদীগুলির সাথে মিশ্রিত হয়। আবার মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আসামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অধিক।অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীগুলি ফুলে ফেঁপে উভয় তীর প্লাবিত করে সৃষ্টি করে বন্যার।
আসামে বন্যার কৃত্রিম কারণ : আসামের পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষ জমচাষের জন্য বনজঙ্গল আর গাছপালা অনবরত কেটে চলছে। এর ফলে বর্ষার সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতে এসব অঞ্চলে ভূমিক্ষয় হয়ে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মত্তিকা ফলে দিন দিন নদী গর্ভগুলি কৃত্রিমভাবে ভরে উঠেছে। আর নদীর স্বাভাবিক খরোস্রোতা হচ্ছে নষ্ট। এভাবে নদীর উপর উচু হয়ে জল ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে বন্যার। এভাবে দেখা যাচ্ছে বর্ষার আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত পাঁচবার বন্যা এসে জনজীবন বিপর্যস্ত করছে।
বন্যার অতর্কিতে আবির্ভাব : বর্ষাকালে সাধারণত অতি বৃষ্টির ফলে জল ফুলে ফেপে তার শাখা নদীগুলিকে স্ফীত করে উপচিয়ে পড়ে। কখনও নদী বাধ’ বা স্থানে স্থানে বাঁধ ডিঙিয়ে প্রচণ্ড বেগে জনপদ আর শস্যক্ষেত্র গ্রাস করে যেন মায়াবী অজগর ভাঙ্গা বাঁধের সরুপথে গলে বের হয়ে ছুটছে আর ভয়ঙ্করভাবে সে দুর্নিবার বেগে সরু দেহখানিকে বিস্তার করছে, সম্মুখে যা পড়ছে তা-ই এ অজগর গ্রাস করে নিচ্ছে। এভাবে বাঁধ ভেঙ্গে ঘরবাড়ি, গ্রাম, প্রান্তর ভাসিয়ে মুহুর্তে সব একাকার করে দেয়। মানুষকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার সুযােগ দেয় না। এভাবে অতর্কিতে আবির্ভাব হয় বন্যার।
বন্যার ভয়াবহ রূপ : মানুষের বহুদিনের বহু কষ্টে সাজানাে ঘরদোর জলাঞ্জলি দিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা তখন পালানাের পথ পায় না। কাছে উচু টিলা বা উচু জায়গা, পাকা বাড়ির ছাদ, উঁচু সরকারি কার্যালয় যেখানে পারে সেখানেই আশ্রয় লওয়ার চেষ্টা করে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়। শিশু ও বৃদ্ধ আর গরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর প্রভৃতির অধিকাংশ তখন রক্ষা পায় না। জলের তীব্রবেগে গাছ, বাঁশঝাড় উপড়িয়ে ঘর ভেঙ্গে ভেসে নিয়ে চলে। দিগন্ত • জুড়ে একটা সাগর যেন অনন্ত ক্ষুধায় হাঁ করে আসছে। যেদিকে যতটুকু তাকানাে যায়কবির ভাষায় –
‘জল আর শুধ
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল ।
খল জল ছলভরা তুমি লক্ষ ফণা
ফুসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা।
মৃত্তিকার শিশুদের লালায়িত মুখ।
এভাবে এক একটা অঞ্চল ধুইয়ে মুছে বন্যার গর্ভে লীন হয়ে যায়। মানুষ চোখের সম্মুখে দেখতে পায় ঈশ্বরের রুদ্র মহিমা। বন্যার ফলে যে শুধু বন্যা দুর্গত অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাই নয়, সমগ্র রাজ্যেই এর প্রভাব অনুভূত হয়।
বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জেলাগুলি : ভৌগােলিক মানদণ্ডে আসামের সমস্ত ভূ-খণ্ডকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা – (১) ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও (২) বরাক উপত্যকা। বর্ষার আরম্ভেই এ দুটি এলাকার ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদী এবং তাদের উপনদীগুলি প্রলয়ঙ্করী রূপ নেয়। এর ফলে ব্ৰহ্মপত্র ও তার উপনদীগুলির দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় উজান আসামের ধেমাজি, ডিব্ৰুগড়, তিনসুকিয়া, উত্তর লক্ষীমপুর আর নিম্ন আসামের গােয়ালপাড়া; ধুবড়ী, বরপেটা প্রভৃতি জিলা। আবার বরাক ও তার উপনদীগুলির দ্বারা কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি প্রভৃতি জেলায় হাহাকার সৃষ্টি হয়।
বন্যার জল নেমে যাওয়ার পরবর্তী অবস্থা ? যাই হােক, মানুষ সামাজিক জীব। তাই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে একে অন্যের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, এগিয়ে আসে অনেক স্বেচ্ছাচারী সংগঠন।
জীবনে যেভাবে কোন দুঃখই চিরস্থায়ী নয়। তাই এ জল-প্লাবনও ধীরে ধীরে কমতে থাকে তখন গ্রাম জাগে কিন্তু কি এক কদর্য রূপধারণ করে চারদিকে পচা দুর্গন্ধ। শস্যক্ষেত্র বিধ্বস্ত, নষ্ট হয়েছে ফসল, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে ঘরবাড়ি। প্রতিটি জেলায়ই মৃত্যুর সংবাদ। সড়ক ও টেলিযােগাযােগ, জল-বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
বন্যার উপকার : বন্যা যে শুধু অনিষ্ট সাধন বা ধ্বংস করে তা নয়। বন্যার ফলে পাহাড়-পর্বত হতে আনিত পলিমাটির দ্বারা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। বাঁধভেঙ্গে জলের সঙ্গে পলিমাটি এসে বড় বড় মাঠের শষ্যক্ষেতের উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া শহর বন্দরের আবর্জনা ধুইয়ে প্রকৃতি নির্মল করে। গাছ-পালা, ফসল সবুজে সবুজ হয়ে উঠে।
প্রতিকারের ব্যবস্থা : ব্ৰহ্মপুত্ৰ বন্যা-নিয়ন্ত্রণ আয়ােগ গঠিত হলেও এ বিষয়ে কিছুই কাজ হয়নি। আসাম সরকার নিজস্ব উদ্যোগে নদীগুলির বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দেবার ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সুতরাং যে সব নদীতে প্রতি বৎসর বন্যা দেখা দেয় সেসব নদীর কয়েকটি উপধারা সৃষ্টির প্রয়ােজন। তাছাড়া বড় বড় নদীগুলির কাছাকাছি যে সকল ছােট ছােট নদী আছে তাদের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করে জলের স্রোতের দিক পরিবর্তন করে বন্যার বেগ কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বাঁধগুলিকে চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে যেভাবে বৈজ্ঞানিক সম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে আসামের নদীগুলির বাঁধগুলিও সেভাবে তৈয়ার করা প্রয়ােজন। পাহাড়ের জল বৃহৎ জলাধারে সঞ্চিত রেখে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনও সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে বরাকের ‘টিপাইমুখ’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বরাক উপত্যকার বন্যা বহুলাংশে কমানাে সম্ভব। উত্তর পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী অঞ্চলের জুম চাষ বন্ধ করা একান্ত প্রয়ােজন। বিকল্প ব্যবস্থা দ্বারা নদীগর্ভ খনন করানাে উচিত। তাহলে নদীর জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি হবে। এ কাজগুলি আসাম সরকারের অবশ্যই কর্তব্য।
উপসংহার : গ্রহান্তরে পাড়ি জমালেও মানুষ আজও প্রকৃতির হাতে অসহায় । আসামের ভয়াবহ বন্যা মাঝে মাঝে আমাদের একথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তবুও ঈশ্বরের উপর ভরসা রেখে এ আশা প্রকাশ করা চলে যে আসামের জনজীবন একদিন বন্যার অভিশাপ হতে অবশ্যই মুক্ত হবে।