শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী ও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান
ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড তার কবি ও সাহিত্যিক। তারাই মানবসভ্যতার আলােকস্তম্ভ। তাদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ দেয়। সাহিত্যিকরা দেশকালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের মঙ্গলদৃত। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই আমার প্রিয় সাহিত্যিক যখন বঙ্কিম যুগ প্রায় অস্তমিত আর বাঙ্গালা সাহিত্যের আকাশে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা দীপ্তিতে ভাস্কর তখন বাংলার সাহিত্য গগনে আবির্ভাব আমার প্রিয় সাহিতিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : ১৮৭৬ সালে শরৎচন্দ্র হুগলী জেলার দেবানন্দপূরে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভূবন মােহিনা দেবী। শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশােরকাল অতিবাহিত হয় বিহারের ভগলপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হন কিন্তু এফ. এ. পরীক্ষার ফি দিতে অপারক হওয়ায় এখানেই তার পড়ার ইতি পড়ে।
প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্র : যে কথা সাহিত্যে আছেন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যেখানে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , আর আছেন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক/উপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক বন্দোপাধ্যায় র মতাে সুনাম ধন্য লেখক/উপন্যাসিক সে জায়গায় শরৎচন্দ্রকে প্রিয় রূপে দেখাতে গেলে সে স্বাভাবিক ভাবে কথা উঠতেই পারে।কিন্তু শরৎসাহিত্য জগৎ আমাদের পরিচিত মৃত্তিকার জগৎ। এ জগতের প্রতিটি মানুষই আমাদের মতাে সুখকান্না, পতন, প্রেম, অশ্রু হাহাকার আলােড়নে বিলোড়ণে উচ্ছ্বসিত। তারা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, শােষিত, অত্যাচারিত- যাদের বুক ফটে তবুও মুখ না। শরৎচন্দ্র তাদের কথাই বলে গেছেন। তাইতাে শরৎচন্দ্র বাংলার সবচেয়ে দরদী ও জীবনরস পরিবেশনের রসিক লেখক/সাহিত্যিক/উপন্যাসিক।
সাহিত্য চর্চার সুচনা ও সাহিত্য সম্ভার : মাত্র চৌদ্দবছর বয়সেই শরৎচন্দ্র ‘কাশীনাথ’ নামে একখানি উপন্যাস রচনা করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দির নামক গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। তারপর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্র অনিলা দেবী ছদ্ম নামে বড়দিদি উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তার রচিত ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’ পরিণত গল্প ও ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’, ‘দেনা পাওনা’, পথের দাবী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি উপন্যাস মানুষের স্নেহ-প্রীতি, কোমল হৃদয় বৃত্তি এবং চিরন্তন মানবিক দুর্বলতার বিষয় নিয়ে রচিত। সে জন্য এ সকল রচনা সহজেই পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। একমাত্র তার সাহিত্যেই আছে অসহায়, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানবাত্মার প্রতি সমবেদনা। সমাজ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত উত্থানপতনের মধ্যে বিচিত্র নর-নারীর বৈচিত্র্যময় রূপের কত বিপুল পরিচয় যে শরৎসাহিত্যে ছড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।
শরৎ সাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিভা : শিল্পী বা সাহিত্যিক ভগবানের মতাে তার শিল্পের রাজ্যে সকলের প্রতিই তিনি সত্যের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। তবে সামাজিক, মানুষ হিসেবে বিশেষ বিশেষ করুণ চিত্রের প্রতি তার সহানুভূতি বিশেষভাবে প্রকট। এ জন্য তার গল্প বা উপন্যাসে দরিদ্রের প্রতি অসীম মমতা ছিল। সেকালে ম্যালেরিয়াপীড়িত, কলেরা-অধ্যষিত অনাহারে অর্ধহারে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দেশে উপনীত হওয়া মানুষগুলিকেই তিনি গভীর ভাবে ভালােবেসে ছিলেন। তাই শহর অপেক্ষা গ্রামের মানুষের প্রতি ছিল তার সহানুভূতি অতি প্রবল।
শরৎসাহিত্যে নারী : শরৎ সাহিত্যে নারীকে উচ্চস্থানে বসানাে হয়েছে। পুরুষ-প্রধান সমাজে নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে তিনি যে সচেতন ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নারী শুধু যে স্বামীর ভােগ্য বস্তু, সম্পদ বা Commodity, এর বিরুদ্ধে তিনি সােচ্ছার হয়েছেন। পুরুষদের মতাে নারীও যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ এ কথা শরৎচন্দ্রের মতাে জোরের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আর কেউ বলেননি। তার উপন্যাসে অবহেলিত, অপমানিত, বঞ্চিত নায়িকা অল্প স্নেহ, ভালবাসায়, বাৎসল্যে বাঙ্গালীর গাহস্থ জীবনের কেন্দ্রে রাজেন্দ্রানী, অন্নপূর্ণার ন্যায় নারী যে বেশি। পরিমাণে দেখা গিয়েছে তা শরৎচন্দ্রের যে কোন গল্প বা উপন্যাসে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। রামের সমতি’তে নারায়ণই সর্বেসর্বা, ‘বিন্দুর ছেলে’তে বিন্দর দাপটে পরিবারের প্রতিটি নারী-পুরুষ নিম্প্রত হয়েছে। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস শ্রীকান্তে রাজলক্ষ্মী পুরুষ সমাজকে শাসন করছে।
শরৎ সাহিত্যে প্রেম : পৃথিবীতে সকল অধিকারের উৎসই যে প্রেম এ কথাটি শরৎচন্দ্র একবারও আমাদিগকে ভুলতে দেননি। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জীবনানন্দের মতো লম্পট হৃদয়হীন জমিদার শেষপর্যন্ত ভালোবাসায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। শরৎসাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ এবং নারীকে শুধু ভালোবাসার মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আর যেখানে তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরহ প্রবল হয়ে উঠেছে সেখানেই দেখা গেছে যে তারা পারস্পরিক ভালোবাসা হতে বিচ্যুত। আমাদের মনে হয় চৈতন্যদেবের মত শরৎচন্দ্র হয়তো বক্তব্য ছিল যে ভালবাসায় মানুষের চরম পুরুষার্থ। কেননা এর মধ্যে নর নারী নিজেকে মহৎ করে তোলে।
শরৎ সাহিত্যে বালক ও কিশাের চরিত্র : শরৎচন্দ্র বালক ও কিশোরদের মনের গহনে অবলীলাক্রমে ডুব দিতে পেরেছিলেন। ‘মেজদিদি’ উপন্যাসের অসহায়, দরিদ্র, সম্বলহীন নিরুপায় বিধবার একমাত্র সন্তান ১৪ বছরের কেষ্টর সাথে ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পের ‘অরণ্য’ অথবা অকাল পক্ক নরেন একই জীবন্ত সত্তা নিয়ে সমুপস্থিত। কলমের দু-একটি আঁচড়ে এই বালক ও কিশাের গুলির মান-অভিমান অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিতুগুলি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখলে অবাক লাগে, ‘রামের সমতির রামের ছেলে মনুষী ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কিশাের শ্রীকান্ত, চন্দ্রনাথ, সতীশ এবং অন্যান্য বেপরােয়া বালক গুলির কথা খুব সহজে ভুলা যায় না। কিশাের ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি তার এক অনবদ্য সৃষ্টি।
শরৎ সাহিত্যে ভাষা : বস্তুত শরৎচন্দ্রের হাতে সহজ-সরল লােক চলিত ভাষার সঙ্গে আবেগ যুক্ত হয়ে এটি এমন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে যে পড়ামাত্র মর্মের ভিতরে গিয়ে সাড়া জাগায়। শরৎচন্দ্রের জন হৃদয় জয়ের অন্যতম কারণ এই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষা। এসব কারণেই বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।।
উপসংহার : বাস্তবতা, নারীচরিত্র, পরুষ-চরিত্র, বালক ও কিশাের চরিত্র বর্ণনা ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎসাহিত্যের মােহময় জনপ্রিয়তার নিকট আর কোন বাঙ্গালি সাহিত্যিক বা উপন্যাসিক কাছাকাছিও আসতে পারবেন না । এখনও যদি পল্লী-বাংলার অর্ধ শিক্ষিত গৃহবধূ বলেন যে তিনি জীবনে মাত্র একখানি উপন্যাস কিংবা গল্প পড়েছেন তা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে নিঃসন্দে বলতে পারি যে উপন্যাস বা গল্পখানি শরৎচন্দ্রের লিখা। এসব কারণে শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় লেখক/সাহিত্যিক /উপন্যাসিক।
Hridoy
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী ও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান
ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড তার কবি ও সাহিত্যিক। তারাই মানবসভ্যতার আলােকস্তম্ভ। তাদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ দেয়। সাহিত্যিকরা দেশকালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের মঙ্গলদৃত। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই আমার প্রিয় সাহিত্যিক যখন বঙ্কিম যুগ প্রায় অস্তমিত আর বাঙ্গালা সাহিত্যের আকাশে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা দীপ্তিতে ভাস্কর তখন বাংলার সাহিত্য গগনে আবির্ভাব আমার প্রিয় সাহিতিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : ১৮৭৬ সালে শরৎচন্দ্র হুগলী জেলার দেবানন্দপূরে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভূবন মােহিনা দেবী। শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশােরকাল অতিবাহিত হয় বিহারের ভগলপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হন কিন্তু এফ. এ. পরীক্ষার ফি দিতে অপারক হওয়ায় এখানেই তার পড়ার ইতি পড়ে।
প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্র : যে কথা সাহিত্যে আছেন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যেখানে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , আর আছেন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক/উপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক বন্দোপাধ্যায় র মতাে সুনাম ধন্য লেখক/উপন্যাসিক সে জায়গায় শরৎচন্দ্রকে প্রিয় রূপে দেখাতে গেলে সে স্বাভাবিক ভাবে কথা উঠতেই পারে।কিন্তু শরৎসাহিত্য জগৎ আমাদের পরিচিত মৃত্তিকার জগৎ। এ জগতের প্রতিটি মানুষই আমাদের মতাে সুখকান্না, পতন, প্রেম, অশ্রু হাহাকার আলােড়নে বিলোড়ণে উচ্ছ্বসিত। তারা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, শােষিত, অত্যাচারিত- যাদের বুক ফটে তবুও মুখ না। শরৎচন্দ্র তাদের কথাই বলে গেছেন। তাইতাে শরৎচন্দ্র বাংলার সবচেয়ে দরদী ও জীবনরস পরিবেশনের রসিক লেখক/সাহিত্যিক/উপন্যাসিক।
সাহিত্য চর্চার সুচনা ও সাহিত্য সম্ভার : মাত্র চৌদ্দবছর বয়সেই শরৎচন্দ্র ‘কাশীনাথ’ নামে একখানি উপন্যাস রচনা করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দির নামক গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। তারপর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্র অনিলা দেবী ছদ্ম নামে বড়দিদি উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তার রচিত ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’ পরিণত গল্প ও ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’, ‘দেনা পাওনা’, পথের দাবী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি উপন্যাস মানুষের স্নেহ-প্রীতি, কোমল হৃদয় বৃত্তি এবং চিরন্তন মানবিক দুর্বলতার বিষয় নিয়ে রচিত। সে জন্য এ সকল রচনা সহজেই পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। একমাত্র তার সাহিত্যেই আছে অসহায়, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানবাত্মার প্রতি সমবেদনা। সমাজ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত উত্থানপতনের মধ্যে বিচিত্র নর-নারীর বৈচিত্র্যময় রূপের কত বিপুল পরিচয় যে শরৎসাহিত্যে ছড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।
শরৎ সাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিভা : শিল্পী বা সাহিত্যিক ভগবানের মতাে তার শিল্পের রাজ্যে সকলের প্রতিই তিনি সত্যের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। তবে সামাজিক, মানুষ হিসেবে বিশেষ বিশেষ করুণ চিত্রের প্রতি তার সহানুভূতি বিশেষভাবে প্রকট। এ জন্য তার গল্প বা উপন্যাসে দরিদ্রের প্রতি অসীম মমতা ছিল। সেকালে ম্যালেরিয়াপীড়িত, কলেরা-অধ্যষিত অনাহারে অর্ধহারে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দেশে উপনীত হওয়া মানুষগুলিকেই তিনি গভীর ভাবে ভালােবেসে ছিলেন। তাই শহর অপেক্ষা গ্রামের মানুষের প্রতি ছিল তার সহানুভূতি অতি প্রবল।
শরৎসাহিত্যে নারী : শরৎ সাহিত্যে নারীকে উচ্চস্থানে বসানাে হয়েছে। পুরুষ-প্রধান সমাজে নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে তিনি যে সচেতন ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নারী শুধু যে স্বামীর ভােগ্য বস্তু, সম্পদ বা Commodity, এর বিরুদ্ধে তিনি সােচ্ছার হয়েছেন। পুরুষদের মতাে নারীও যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ এ কথা শরৎচন্দ্রের মতাে জোরের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আর কেউ বলেননি। তার উপন্যাসে অবহেলিত, অপমানিত, বঞ্চিত নায়িকা অল্প স্নেহ, ভালবাসায়, বাৎসল্যে বাঙ্গালীর গাহস্থ জীবনের কেন্দ্রে রাজেন্দ্রানী, অন্নপূর্ণার ন্যায় নারী যে বেশি। পরিমাণে দেখা গিয়েছে তা শরৎচন্দ্রের যে কোন গল্প বা উপন্যাসে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। রামের সমতি’তে নারায়ণই সর্বেসর্বা, ‘বিন্দুর ছেলে’তে বিন্দর দাপটে পরিবারের প্রতিটি নারী-পুরুষ নিম্প্রত হয়েছে। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস শ্রীকান্তে রাজলক্ষ্মী পুরুষ সমাজকে শাসন করছে।
শরৎ সাহিত্যে প্রেম : পৃথিবীতে সকল অধিকারের উৎসই যে প্রেম এ কথাটি শরৎচন্দ্র একবারও আমাদিগকে ভুলতে দেননি। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জীবনানন্দের মতো লম্পট হৃদয়হীন জমিদার শেষপর্যন্ত ভালোবাসায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। শরৎসাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ এবং নারীকে শুধু ভালোবাসার মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আর যেখানে তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরহ প্রবল হয়ে উঠেছে সেখানেই দেখা গেছে যে তারা পারস্পরিক ভালোবাসা হতে বিচ্যুত। আমাদের মনে হয় চৈতন্যদেবের মত শরৎচন্দ্র হয়তো বক্তব্য ছিল যে ভালবাসায় মানুষের চরম পুরুষার্থ। কেননা এর মধ্যে নর নারী নিজেকে মহৎ করে তোলে।
শরৎ সাহিত্যে বালক ও কিশাের চরিত্র : শরৎচন্দ্র বালক ও কিশোরদের মনের গহনে অবলীলাক্রমে ডুব দিতে পেরেছিলেন। ‘মেজদিদি’ উপন্যাসের অসহায়, দরিদ্র, সম্বলহীন নিরুপায় বিধবার একমাত্র সন্তান ১৪ বছরের কেষ্টর সাথে ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পের ‘অরণ্য’ অথবা অকাল পক্ক নরেন একই জীবন্ত সত্তা নিয়ে সমুপস্থিত। কলমের দু-একটি আঁচড়ে এই বালক ও কিশাের গুলির মান-অভিমান অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিতুগুলি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখলে অবাক লাগে, ‘রামের সমতির রামের ছেলে মনুষী ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কিশাের শ্রীকান্ত, চন্দ্রনাথ, সতীশ এবং অন্যান্য বেপরােয়া বালক গুলির কথা খুব সহজে ভুলা যায় না। কিশাের ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি তার এক অনবদ্য সৃষ্টি।
শরৎ সাহিত্যে ভাষা : বস্তুত শরৎচন্দ্রের হাতে সহজ-সরল লােক চলিত ভাষার সঙ্গে আবেগ যুক্ত হয়ে এটি এমন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে যে পড়ামাত্র মর্মের ভিতরে গিয়ে সাড়া জাগায়। শরৎচন্দ্রের জন হৃদয় জয়ের অন্যতম কারণ এই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষা। এসব কারণেই বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।।
উপসংহার : বাস্তবতা, নারীচরিত্র, পরুষ-চরিত্র, বালক ও কিশাের চরিত্র বর্ণনা ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎসাহিত্যের মােহময় জনপ্রিয়তার নিকট আর কোন বাঙ্গালি সাহিত্যিক বা উপন্যাসিক কাছাকাছিও আসতে পারবেন না । এখনও যদি পল্লী-বাংলার অর্ধ শিক্ষিত গৃহবধূ বলেন যে তিনি জীবনে মাত্র একখানি উপন্যাস কিংবা গল্প পড়েছেন তা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে নিঃসন্দে বলতে পারি যে উপন্যাস বা গল্পখানি শরৎচন্দ্রের লিখা। এসব কারণে শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় লেখক/সাহিত্যিক /উপন্যাসিক।