শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা/ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্ব
ভূমিকা : মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বােধের জন্ম। মাতৃভাষার দ্বারাই শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে। শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমনই গুরুত্ব। মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে।
সার্বিক ক্ষেত্রে মাতৃভাষা : মাতৃভূমির মতাে মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয়। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব। মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি। কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ ঘটে।
বিদেশি ভাষা এবং তাঁর সমস্যা : শিক্ষার মাধ্যমরূপে বিদেশি ভাষাকে অবলম্বন করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। তার কতকগুলি কারণ আছে। প্রথমতঃ বিদেশি ভাষাকে আয়ত্ত করতে যে কোন মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। দ্বিতীয়তঃ বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা যতই করায়ত্ত হােক না কেন তার মাধ্যমে মাতৃভাষার মতাে মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না।
মাতৃভাষায় শিক্ষা : শিক্ষা ও জীবনের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের জন্য মাধ্যম হওয়া উচিত মাতৃভাষা। একমাত্র মাতৃভাষাই পারে প্রাণের সঙ্গে ভাবের সম্মিলন ঘটাতে। শুধু কাজ নয়, ভাব প্রকাশই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য। মাতৃভাষাই মানুষের মুক্তির যথার্থ উপায়। মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণে আপামর জনসাধারণের পক্ষে সহজ। গভীর আনন্দে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষা তার পক্ষে ভার হয়ে দাড়ায় না। মাতৃভাষা শিক্ষা নেওয়ার পরে মানুষ নিজের ইচ্ছেমতাে যে কোন ভাষায় শিক্ষা নিতে পারে।
বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা : জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রটি আজও দুর্বল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে ইউরোপীয় মিশনারিদের চেষ্টায় এদেশে সর্বপ্রথম বাংলাভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটে। রাজা রামমােহন রায় সর্বপ্রথম এই ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখােপাধ্যায়, কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব লাভ করে।
বাংলা ভাষা ও তাঁর ধারণ ক্ষমতা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। অনেকে হয়তাে যুক্তি দেখাবেন যে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার পথই একমাত্র পথ কারণ কিছু বিষয় | যেমন অর্থনীতি, ভূতত্ত্ববিদ্যা, বিজ্ঞান বিষয় সমূহকে মাতৃভাষার মাধ্যমে যথার্থ শিক্ষাদান সম্ভব হয় না। একথা হয়তাে আংশিক সত্য। কিন্তু তবুও অনুপযুক্ত বলে চিরকালই তা অনুপযুক্তই থাকবে এমন কোন কথা নেই।
উপসংহার : মাতৃভাষা যে শিক্ষার সর্বস্তরে মাধ্যম হিসাবে কার্যত গৃহিত হতে পারছে না এর মূলে পণ্ডিত অধ্যাপকদের মানসিক জাড্য এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি মােহ। বাংলায় যে সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থাদি রচিত হয়নি তার দায় পণ্ডিত সমাজ অস্বীকার করতে পারবে না। জাপান-রাশিয়া-জার্মানি সুচনা থেকেই মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ স্তরের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়ােগ করেছেন। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা বাংলা সে বিষয়ে অক্ষম একথা স্বীকার করা যায় না। শুধু প্রতিষ্ঠানিক বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে বাংলা তথা অন্যান্য মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে রাখা লজ্জাকর। শিক্ষাকে সার্বজনীন ও উচ্চমানের করতে হলে মাতৃভাষার প্রতি এই মনােভাব অবশ্য বর্জন করতে হবে।
Hridoy
শিক্ষার মাধ্যমরূপে মাতৃভাষা/ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্ব
ভূমিকা : মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথম বােধের জন্ম। মাতৃভাষার দ্বারাই শিশুর চেতনার বিকাশ ঘটে। শিশুর কাছে মাতার যেমন গুরুত্ব, শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষারও তেমনই গুরুত্ব। মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা লাভ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই তার জীবন নানাভাবে বিকাশ লাভ করে।
সার্বিক ক্ষেত্রে মাতৃভাষা : মাতৃভূমির মতাে মাতৃভাষাও মানুষের নিকট একান্ত প্রিয়। মাতৃভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের সার্বিক বিকাশ সম্ভব। মাতৃভাষাতেই মানুষের পরম তৃপ্তি। কারণ, এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে মানুষ যত আনন্দ পায় অন্যভাষায় কথা বলে তা পায় না। মাতৃভাষা শুধু প্রাত্যহিক জীবনের অবলম্বন নয় – এর মাধ্যমে সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সাধনার বিকাশ ঘটে।
বিদেশি ভাষা এবং তাঁর সমস্যা : শিক্ষার মাধ্যমরূপে বিদেশি ভাষাকে অবলম্বন করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। তার কতকগুলি কারণ আছে। প্রথমতঃ বিদেশি ভাষাকে আয়ত্ত করতে যে কোন মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। দ্বিতীয়তঃ বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা যতই করায়ত্ত হােক না কেন তার মাধ্যমে মাতৃভাষার মতাে মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না।
মাতৃভাষায় শিক্ষা : শিক্ষা ও জীবনের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের জন্য মাধ্যম হওয়া উচিত মাতৃভাষা। একমাত্র মাতৃভাষাই পারে প্রাণের সঙ্গে ভাবের সম্মিলন ঘটাতে। শুধু কাজ নয়, ভাব প্রকাশই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য। মাতৃভাষাই মানুষের মুক্তির যথার্থ উপায়। মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণে আপামর জনসাধারণের পক্ষে সহজ। গভীর আনন্দে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে। শিক্ষা তার পক্ষে ভার হয়ে দাড়ায় না। মাতৃভাষা শিক্ষা নেওয়ার পরে মানুষ নিজের ইচ্ছেমতাে যে কোন ভাষায় শিক্ষা নিতে পারে।
বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা : জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রটি আজও দুর্বল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে ইউরোপীয় মিশনারিদের চেষ্টায় এদেশে সর্বপ্রথম বাংলাভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটে। রাজা রামমােহন রায় সর্বপ্রথম এই ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখােপাধ্যায়, কৃষ্ণমােহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায় বিষয়টি আরও গুরুত্ব লাভ করে।
বাংলা ভাষা ও তাঁর ধারণ ক্ষমতা : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। অনেকে হয়তাে যুক্তি দেখাবেন যে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার পথই একমাত্র পথ কারণ কিছু বিষয় | যেমন অর্থনীতি, ভূতত্ত্ববিদ্যা, বিজ্ঞান বিষয় সমূহকে মাতৃভাষার মাধ্যমে যথার্থ শিক্ষাদান সম্ভব হয় না। একথা হয়তাে আংশিক সত্য। কিন্তু তবুও অনুপযুক্ত বলে চিরকালই তা অনুপযুক্তই থাকবে এমন কোন কথা নেই।
উপসংহার : মাতৃভাষা যে শিক্ষার সর্বস্তরে মাধ্যম হিসাবে কার্যত গৃহিত হতে পারছে না এর মূলে পণ্ডিত অধ্যাপকদের মানসিক জাড্য এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি মােহ। বাংলায় যে সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থাদি রচিত হয়নি তার দায় পণ্ডিত সমাজ অস্বীকার করতে পারবে না। জাপান-রাশিয়া-জার্মানি সুচনা থেকেই মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ স্তরের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়ােগ করেছেন। বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা বাংলা সে বিষয়ে অক্ষম একথা স্বীকার করা যায় না। শুধু প্রতিষ্ঠানিক বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে বাংলা তথা অন্যান্য মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে রাখা লজ্জাকর। শিক্ষাকে সার্বজনীন ও উচ্চমানের করতে হলে মাতৃভাষার প্রতি এই মনােভাব অবশ্য বর্জন করতে হবে।