শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী ও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড তার কবি ও সাহিত্যিক। তারাই মানবসভ্যতার আলােকস্তম্ভ। তাদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ দেয়। সাহিত্যিকরা দেশকালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের মঙ্গলদৃত। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ইRead more
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জীবনী ও বাংলা সাহিত্যে তার অবদান
ভূমিকা : কোন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানদণ্ড তার কবি ও সাহিত্যিক। তারাই মানবসভ্যতার আলােকস্তম্ভ। তাদের সৃষ্টি মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ দেয়। সাহিত্যিকরা দেশকালের উর্ধ্বে, তারা বিশ্বমানবের মঙ্গলদৃত। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই আমার প্রিয় সাহিত্যিক যখন বঙ্কিম যুগ প্রায় অস্তমিত আর বাঙ্গালা সাহিত্যের আকাশে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা দীপ্তিতে ভাস্কর তখন বাংলার সাহিত্য গগনে আবির্ভাব আমার প্রিয় সাহিতিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।
জন্ম ও বংশ পরিচয় : ১৮৭৬ সালে শরৎচন্দ্র হুগলী জেলার দেবানন্দপূরে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতা ভূবন মােহিনা দেবী। শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশােরকাল অতিবাহিত হয় বিহারের ভগলপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হন কিন্তু এফ. এ. পরীক্ষার ফি দিতে অপারক হওয়ায় এখানেই তার পড়ার ইতি পড়ে।
প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্র : যে কথা সাহিত্যে আছেন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যেখানে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , আর আছেন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক/উপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক বন্দোপাধ্যায় র মতাে সুনাম ধন্য লেখক/উপন্যাসিক সে জায়গায় শরৎচন্দ্রকে প্রিয় রূপে দেখাতে গেলে সে স্বাভাবিক ভাবে কথা উঠতেই পারে।কিন্তু শরৎসাহিত্য জগৎ আমাদের পরিচিত মৃত্তিকার জগৎ। এ জগতের প্রতিটি মানুষই আমাদের মতাে সুখকান্না, পতন, প্রেম, অশ্রু হাহাকার আলােড়নে বিলোড়ণে উচ্ছ্বসিত। তারা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, শােষিত, অত্যাচারিত- যাদের বুক ফটে তবুও মুখ না। শরৎচন্দ্র তাদের কথাই বলে গেছেন। তাইতাে শরৎচন্দ্র বাংলার সবচেয়ে দরদী ও জীবনরস পরিবেশনের রসিক লেখক/সাহিত্যিক/উপন্যাসিক।
সাহিত্য চর্চার সুচনা ও সাহিত্য সম্ভার : মাত্র চৌদ্দবছর বয়সেই শরৎচন্দ্র ‘কাশীনাথ’ নামে একখানি উপন্যাস রচনা করেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দির নামক গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। তারপর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতী পত্রিকায় শরৎচন্দ্র অনিলা দেবী ছদ্ম নামে বড়দিদি উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তার রচিত ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’ পরিণত গল্প ও ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’, ‘দেনা পাওনা’, পথের দাবী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি উপন্যাস মানুষের স্নেহ-প্রীতি, কোমল হৃদয় বৃত্তি এবং চিরন্তন মানবিক দুর্বলতার বিষয় নিয়ে রচিত। সে জন্য এ সকল রচনা সহজেই পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। একমাত্র তার সাহিত্যেই আছে অসহায়, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানবাত্মার প্রতি সমবেদনা। সমাজ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত উত্থানপতনের মধ্যে বিচিত্র নর-নারীর বৈচিত্র্যময় রূপের কত বিপুল পরিচয় যে শরৎসাহিত্যে ছড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।
শরৎ সাহিত্যে বাস্তবতার প্রতিভা : শিল্পী বা সাহিত্যিক ভগবানের মতাে তার শিল্পের রাজ্যে সকলের প্রতিই তিনি সত্যের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। তবে সামাজিক, মানুষ হিসেবে বিশেষ বিশেষ করুণ চিত্রের প্রতি তার সহানুভূতি বিশেষভাবে প্রকট। এ জন্য তার গল্প বা উপন্যাসে দরিদ্রের প্রতি অসীম মমতা ছিল। সেকালে ম্যালেরিয়াপীড়িত, কলেরা-অধ্যষিত অনাহারে অর্ধহারে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দেশে উপনীত হওয়া মানুষগুলিকেই তিনি গভীর ভাবে ভালােবেসে ছিলেন। তাই শহর অপেক্ষা গ্রামের মানুষের প্রতি ছিল তার সহানুভূতি অতি প্রবল।
শরৎসাহিত্যে নারী : শরৎ সাহিত্যে নারীকে উচ্চস্থানে বসানাে হয়েছে। পুরুষ-প্রধান সমাজে নারীর উপর যে অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে তিনি যে সচেতন ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। নারী শুধু যে স্বামীর ভােগ্য বস্তু, সম্পদ বা Commodity, এর বিরুদ্ধে তিনি সােচ্ছার হয়েছেন। পুরুষদের মতাে নারীও যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ এ কথা শরৎচন্দ্রের মতাে জোরের সঙ্গে তখন পর্যন্ত আর কেউ বলেননি। তার উপন্যাসে অবহেলিত, অপমানিত, বঞ্চিত নায়িকা অল্প স্নেহ, ভালবাসায়, বাৎসল্যে বাঙ্গালীর গাহস্থ জীবনের কেন্দ্রে রাজেন্দ্রানী, অন্নপূর্ণার ন্যায় নারী যে বেশি। পরিমাণে দেখা গিয়েছে তা শরৎচন্দ্রের যে কোন গল্প বা উপন্যাসে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। রামের সমতি’তে নারায়ণই সর্বেসর্বা, ‘বিন্দুর ছেলে’তে বিন্দর দাপটে পরিবারের প্রতিটি নারী-পুরুষ নিম্প্রত হয়েছে। তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস শ্রীকান্তে রাজলক্ষ্মী পুরুষ সমাজকে শাসন করছে।
শরৎ সাহিত্যে প্রেম : পৃথিবীতে সকল অধিকারের উৎসই যে প্রেম এ কথাটি শরৎচন্দ্র একবারও আমাদিগকে ভুলতে দেননি। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে জীবনানন্দের মতো লম্পট হৃদয়হীন জমিদার শেষপর্যন্ত ভালোবাসায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। শরৎসাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ এবং নারীকে শুধু ভালোবাসার মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আর যেখানে তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরহ প্রবল হয়ে উঠেছে সেখানেই দেখা গেছে যে তারা পারস্পরিক ভালোবাসা হতে বিচ্যুত। আমাদের মনে হয় চৈতন্যদেবের মত শরৎচন্দ্র হয়তো বক্তব্য ছিল যে ভালবাসায় মানুষের চরম পুরুষার্থ। কেননা এর মধ্যে নর নারী নিজেকে মহৎ করে তোলে।
শরৎ সাহিত্যে বালক ও কিশাের চরিত্র : শরৎচন্দ্র বালক ও কিশোরদের মনের গহনে অবলীলাক্রমে ডুব দিতে পেরেছিলেন। ‘মেজদিদি’ উপন্যাসের অসহায়, দরিদ্র, সম্বলহীন নিরুপায় বিধবার একমাত্র সন্তান ১৪ বছরের কেষ্টর সাথে ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পের ‘অরণ্য’ অথবা অকাল পক্ক নরেন একই জীবন্ত সত্তা নিয়ে সমুপস্থিত। কলমের দু-একটি আঁচড়ে এই বালক ও কিশাের গুলির মান-অভিমান অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিতুগুলি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখলে অবাক লাগে, ‘রামের সমতির রামের ছেলে মনুষী ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কিশাের শ্রীকান্ত, চন্দ্রনাথ, সতীশ এবং অন্যান্য বেপরােয়া বালক গুলির কথা খুব সহজে ভুলা যায় না। কিশাের ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি তার এক অনবদ্য সৃষ্টি।
শরৎ সাহিত্যে ভাষা : বস্তুত শরৎচন্দ্রের হাতে সহজ-সরল লােক চলিত ভাষার সঙ্গে আবেগ যুক্ত হয়ে এটি এমন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে যে পড়ামাত্র মর্মের ভিতরে গিয়ে সাড়া জাগায়। শরৎচন্দ্রের জন হৃদয় জয়ের অন্যতম কারণ এই সহজ সরল অনাড়ম্বর ভাষা। এসব কারণেই বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।।
উপসংহার : বাস্তবতা, নারীচরিত্র, পরুষ-চরিত্র, বালক ও কিশাের চরিত্র বর্ণনা ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎসাহিত্যের মােহময় জনপ্রিয়তার নিকট আর কোন বাঙ্গালি সাহিত্যিক বা উপন্যাসিক কাছাকাছিও আসতে পারবেন না । এখনও যদি পল্লী-বাংলার অর্ধ শিক্ষিত গৃহবধূ বলেন যে তিনি জীবনে মাত্র একখানি উপন্যাস কিংবা গল্প পড়েছেন তা হলে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে নিঃসন্দে বলতে পারি যে উপন্যাস বা গল্পখানি শরৎচন্দ্রের লিখা। এসব কারণে শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় লেখক/সাহিত্যিক /উপন্যাসিক।
See less
Hridoy
নেলসন ম্যান্ডেলা ভূমিকা: বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও মহান রাষ্ট্রনায়কদের একজন হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির পিতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এক মহান অবিসংবাদিত নেতা ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ। তিনি বর্ণবাদ নির্মূল তথা জাতীয় ঐক্যের জন্য সারাজীবন সংগ্রামRead more
নেলসন ম্যান্ডেলা
ভূমিকা: বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও মহান রাষ্ট্রনায়কদের একজন হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির পিতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি এক মহান অবিসংবাদিত নেতা ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ। তিনি বর্ণবাদ নির্মূল তথা জাতীয় ঐক্যের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার অক্লান্ত সংগ্রামের ফলেই অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষ স্বাধীনতা, সাম্য ও মুক্তির স্বাদ পেয়েছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ও শৈশবকাল: নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার উমতাতু প্রদেশের এমভাজো গ্রামে টেম্বু রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হেনরি ম্যান্ডেলা, মায়ের নাম নোসেকেনি ফ্যানি। তার ডাকনাম ‘রোরিহ্লাহ্লা’ যার অর্থ ‘গাছের ডাল ভাঙে যে’ অর্থাৎ সমস্যা সৃষ্টিকারী, উপদ্রবকারী বা দুষ্টু ছেলে। দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে তিনি মাদিবা নামে বেশি পরিচিত। তবে পূর্বপুরুষদের নাম অনুযায়ী তার পদবি ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলার দাদা ছিলেন একজন রাজা এবং বাবা ছিলেন টেম্বু উপজাতির গোত্রপ্রধান। জন্মের ৮ বছর বয়সেই তিনি বাবাকে হারান। পরে তার গোত্র প্রধানের পরিচর্যায় বড় হন। তার শৈশবকাল কাটে নানার বাড়িতে। তিনিই তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে পড়ার সময় তার শিক্ষিকা মদিঙ্গানে তার ইংরেজি নাম রাখেন “নেলসন”।
ম্যান্ডেলার শিক্ষাজীবন: স্কুল থেকে পাশ করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস কোর্সে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাই কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তি হিসেবে ফোর্ট হেয়ার থেকে বহিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে জোহানেসবার্গের আইনী প্রতিষ্ঠান উইটকিন সিডেলস্কি অ্যান্ড এডেলম্যানে কেরানি হিসেবে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটার স্ট্যান্ড থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। এসময়ে তিনি জোহানেসবার্গের উত্তর দিকের শহর আলেক্সান্ডিয়াতে বাস করতেন।
রাজনৈতিক জীবন: নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই ১৯৪৪ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দিয়ে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সিসুলু, অলিভার টাম্বার মতো তরুণ, বুদ্ধিদীপ্ত ও নিবেদিতপ্রাণ একনিষ্ঠ কর্মীদের একত্র করে এএনসিকে পুরোপুরি আন্দোলনমুখী দলে পরিণত করেন। ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান নির্বাচনে বর্ণবাদে বিশ্বাসী ও বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করার পক্ষপাতি আফ্রিকানদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে নেলসন ম্যান্ডেলা মহাত্মা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালে জনগণের সম্মেলনেও তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন: ১৯৫৫ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা জনগণের সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হিসেবে ‘স্বাধীনতার সনদ’ বা ‘মুক্তি সনদ’ প্রনয়ণ করেন। ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের কারণে ম্যান্ডেলাকে কমিউনিস্ট দমন আইনে অভিযুক্ত করা হয়। তার সকল প্রকার সভা-সমাবেশ ও ছয় মাস পর্যন্ত জোহানেসবার্গের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ম্যান্ডেলা এএনসির নতুন সাংগঠনিক পরিকল্পনা তৈরি করেন এবং কৃষ্ণাঙ্গ পরিচালিত প্রথম আইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাসহ ১৫৬ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেফতার করে। সুদীর্ঘ ৫ বছর (১৯৫৬-৬১) ধরে মামলা চললে পরে সব আসামী নির্দোষ প্রমাণিত হয় এবং ১৯৬১ সালে সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। ঐ বছর ম্যান্ডেলা এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন ‘উমখান্তো উই সিমওয়ে’ অর্থাৎ ‘দেশের বল্লম’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বর্ণবাদবিরোধী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন। এতে বর্ণবাদী সরকার পিছু না হটলে প্রয়োজনবোধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার জন্যও পরিকল্পনা করেন।
সংগ্রামী জীবন: দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন সফল হবে না বলে ম্যান্ডেলা সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিয়ে ছিলেন। বর্ণবাদভিত্তিক আন্দোলনের কারণে ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করে জোহানেসবার্গের দূর্গে আটকে রাখা হয়। ১৯৬১ সালে শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্বদান এবং বেআইনীভাবে দেশের বাইরে যাবার অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৫ অক্টোবর এই দুই অভিযোগে তাকে ৫ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। এর দুই বছর পর ১৯৬৪ সালের ১১ জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসির সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদান এবং অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে রিভোনিয়া ট্রায়ালে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পরে পাঠানো হয় কুখ্যাত রোবেন দ্বীপের কারাগারে।
ম্যান্ডেলার কারাজীবন: ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রোবেন দ্বীপে। এখানে তিনি তার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। এখানে ম্যান্ডেলা ডি গ্রুপের অর্থাৎ সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায় ছিলেন। তাকে মাত্র দুই মিটার চওড়া ও আড়াই মিটার লম্বা একটি প্রকৌষ্টে রাখা হয়েছিল এবং শোয়ার ব্যবস্থা ছিল মেঝেতে। তাকে প্রতি ৬ মাসে একটি মাত্র চিঠি দেয়া হত এবং একজন মাত্র দর্শনার্থীর সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হত। ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি কারাগারের সেন্সর কর্মীরা অনেকদিন আটকে রাখত এবং অনেক জায়গায় কালি দিয়ে অপাঠযোগ্য করে দিত। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রোবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোল সমুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পরে ১৯৮৮ সালে তাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে নেয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত এ কারাগারেই বন্দী ছিলেন ম্যান্ডেলা।
কারাগার থেকে মুক্তি: ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি পি ডব্লিউ বোথা শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিতে চাইলে ম্যান্ডেলা তা নাকচ করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর মুক্তির জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের উপর চাপ বাড়তে থাকে। ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পদ থেকে সড়ে দাঁড়ান এবং ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক তার স্থলাভিষিক্ত হন। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি: কারামুক্তির পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দলের নেতা ছিলেন। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ক্রিস জানিকে হত্যার ফলে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে ছিল। তখন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতি না থাকা স্বত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি সুলভ ভাষণে দেশবাসীকে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানান। এই সময় তিনি সরকারের সাথে বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে আলোচনায় বসেন। এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হলে ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিকভাবে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। তিনি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
পুরস্কার ও সম্মান: ম্যান্ডেলাকে শত শত পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। গত চার দশকে ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতরত্ম উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি কানাডার সম্মানজনক নাগরিকত্ব, ব্রিটিশ লেবার পার্টি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাবের সম্মানজনক সদস্য হিসেবে সম্মান লাভ করেন। এছাড়া একটি পারমানবিক কনার নাম রাখা হয়েছে ম্যান্ডেলা পার্টিকল। একটি প্রাগৈতিহাসিক কাঠঠোকরা ও একটি অর্কিডের নামকরণও হয়েছে তার নামে। জাতিসংঘ ২০০১ সালে তার জন্ম দিন ১৮ জুলাইকে প্রতিবছর ম্যান্ডেলা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।
বিদায় বেলা/ম্যান্ডেলার অন্তিমকাল/মৃত্যু: রোবেন দ্বীপের নোংরা কারা প্রকোষ্টে থাকার সময় ম্যান্ডেলার শরীরে বাসা বাধে মরণব্যাধি যক্ষ্মা। শেষ বয়সে তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দেয়। দীর্ঘ তিন মাস প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হাসপাতালে থাকার পর জোহানেসবার্গের বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। ১০ দিন ধরে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় নানা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর ১৫ ডিসেম্বর ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের নিজ গ্রাম কুনুতে পারিবারিক সমাধিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
উপসংহার: বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস নেলসন ম্যান্ডেলা। তাঁর অহিংস রাজনীতির আদর্শ ও বর্ণবাদীবিরোধী সংগ্রাম তাকে অনন্তকাল ধরে পৃথিবীবাসীর হৃদয়ে চিরঞ্জীব, চিরস্মরণীয় করে রাখবে। একটি কল্যাণকর ও ন্যায়নিষ্ঠ জাতি গড়ার ক্ষেত্রে তার মূল্যবোধ, ত্যাগ ও সংগ্রাম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
See less