পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী,—
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী।
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আম্র বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুনপুরে দলে দলে আজি
পাঠান সেনা হোরি খেলতে এল
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মূলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি,
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরি-খেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা।—
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি।
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
তেমন ক’রে কাঁকন বাজছে না।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা।
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
পাঠান কহে—রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা।
বাহু যুগল নয় মৃণালের মতো,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত,
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।
পাঠান ভাবে দেহে কিংবা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।
তান ধরিয়া ইমন্ ভূপালিতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুগুলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন ভূপালিতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।
কেসর কহে—তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা।—
রানী কহে—আমারো সেই দশা।—
একশো সখি হাসিয়া বিবশা,—
পাঠানপতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠানপতির চক্ষু হোলো কানা।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
উঠল বেজে কাড়া নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝনঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু তলে তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কেরে
বাহির হোলো নারী-সজ্জা ছেড়ে,
একশত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্ন সম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন রাতে কুঞ্জ বিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হোলো সারা।
যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
Hori Khela Poem by Rabindranath Tagore Recitation:
Horikhela
Rabindranath Tagore
Potro dilo pathan kesor khare
Ketun hote bhunag rajar rani,
Lorai kori aash mitiche miya?
Basanta jay chokher upar diya
Hori khelbo amar rajputani
Juddhe hari kotha sahar chari
Ketun hote patro dilo dilo rani
Patro pori kesor uthe hashi
Moner sukhe gofe dilo chara
Rangin dekhe pagri pore mathe
Surma aaki dilo aakhir pate
Gandhobhora rumal nilo hate
Sahasrabar dari dilo jhara
Pathan sathe hori khelbe rani
Kesor hashi gof dilo chara
Fagun mashe dokkhin hote hawa
Bakulbane matal hoye elo
Bol dhoreche amro bane bane
Bhromor gulo ke kar kotha shune
Gun guniye apon mone mone
Ghure ghure beray elo melo
Ketonpure dole dole aaji
Pathan sena hori khelte elo
Ketonpure rajar uabone
Takhan shobe jhikimiki bela
Pathanera daray abne aashi
Multanete tan dhoreche bashi
Elo takhan eksho ranir dashi
rajputani korte hori khela
Robi takhan raktarage ranga
shobe Takhan jhikimiki bela
Nibedita Paul
হােরিখেলা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাব্যগ্রন্থঃ কথা
(রাজস্থান)
পত্র দিল পাঠান কেসর খাঁরে
কেতুন হতে ভূনাগ রাজার রানী,—
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এসো তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেলব আমরা রাজপুতানী।
যুদ্ধে হারি কোটা শহর ছাড়ি
কেতুন হতে পত্র দিল রানী।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙিন দেখে পাগড়ি পরে মাথে,
সুর্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেলবে রানী
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
ফাগুন মাসে দখিন হতে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হয়ে এল।
বোল ধরেছে আম্র বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুনগুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুনপুরে দলে দলে আজি
পাঠান সেনা হোরি খেলতে এল
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানেরা দাঁড়ায় বনে আসি,
মূলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি,
এল তখন একশো রানীর দাসী
রাজপুতানী করতে হোরি-খেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে
ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।
ডাহিন-হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচ্কারী,
বামহস্তে গুলাব ভরা ঝারী
সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে—
কেসর তবে কহে কাছে আসি’,—
বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি’—
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি।—
শুনে রাজার শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্ট হাসি’।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি’।
শুরু হোলো হোরির মাতামাতি,
উড়তেছে ফাগ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব-বরন ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝরল তরুমূলে,
ভয়ে পাখি কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হতে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা।—
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠছে নাকো দুলি।
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বলছে বেসুর বুলি,
তেমন ক’রে কাঁকন বাজছে না।
চোখে কেন লাগছে নাকো নেশা।
মনে মনে ভাবছে কেসর খাঁ।
পাঠান কহে—রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা।
বাহু যুগল নয় মৃণালের মতো,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত,
বড়ো কঠিন শুষ্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।
পাঠান ভাবে দেহে কিংবা মনে
রাজপুতানীর নাইকো কোমলতা।
তান ধরিয়া ইমন্ ভূপালিতে
বাঁশি বেজে উঠল দ্রুত তালে।
কুগুলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রানী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন ভূপালিতে
বাঁশি তখন বাজছে দ্রুত তালে।
কেসর কহে—তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা।—
রানী কহে—আমারো সেই দশা।—
একশো সখি হাসিয়া বিবশা,—
পাঠানপতির ললাটে সহসা
মারেন রানী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠানপতির চক্ষু হোলো কানা।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মতো
উঠল বেজে কাড়া নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চমকে ওঠে শশী,
ঝনঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধরল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু তলে তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হতে কেরে
বাহির হোলো নারী-সজ্জা ছেড়ে,
একশত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হতে একশো সাপের মতো।
স্বপ্ন সম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
ফাগুন রাতে কুঞ্জ বিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হোলো সারা।
যে-পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা।
Hori Khela Poem by Rabindranath Tagore Recitation:
Horikhela
Rabindranath Tagore
Potro dilo pathan kesor khare
Ketun hote bhunag rajar rani,
Lorai kori aash mitiche miya?
Basanta jay chokher upar diya
Hori khelbo amar rajputani
Juddhe hari kotha sahar chari
Ketun hote patro dilo dilo rani
Patro pori kesor uthe hashi
Moner sukhe gofe dilo chara
Rangin dekhe pagri pore mathe
Surma aaki dilo aakhir pate
Gandhobhora rumal nilo hate
Sahasrabar dari dilo jhara
Pathan sathe hori khelbe rani
Kesor hashi gof dilo chara
Fagun mashe dokkhin hote hawa
Bakulbane matal hoye elo
Bol dhoreche amro bane bane
Bhromor gulo ke kar kotha shune
Gun guniye apon mone mone
Ghure ghure beray elo melo
Ketonpure dole dole aaji
Pathan sena hori khelte elo
Ketonpure rajar uabone
Takhan shobe jhikimiki bela
Pathanera daray abne aashi
Multanete tan dhoreche bashi
Elo takhan eksho ranir dashi
rajputani korte hori khela
Robi takhan raktarage ranga
shobe Takhan jhikimiki bela
Paye paye ghagra uthe dule
Orna ure dokkhin batashe
Dahin hate bohe fager khari
Niboboddhe jhuliche pichkari
Bamhoste golap bhora jhari
Sari sari rajutani aashe
Paye paye ghagra uthe dule
Orna ure dokkhin batashe