হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার ।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো ।
ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
হে নীড়-বিহারী সঙ্গী ! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে । তবু আজো বিস্ময় আমার –
ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ ।
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
তাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল –
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল ।
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে –
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফের দুর্বিপাকে ।
পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার !
সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার :
কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার –
এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার ?
লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম ।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই ।
কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে ।
লোভের মাথায় পদাঘাত হানো-
আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো ।
দৈত্যরাজের যত অনুচর
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর;
মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-
হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ ।
তোমার ফসল, তোমার মাটি
তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
তোমার চেতনা চালিত হাতে ।
এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে ?
স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি ?
এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র ?
করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র :
শোন্ রে মালিক, শোন্রে মজুতদার !
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-
হিসাব কি দিবি তার ?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি ?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই ।
তারপর বহুশত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার ।
তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার
মানুষ ছিল কি ? জবাব মেলে না তার ।
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
আজকের নৈঃশব্দ্য হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি ।
দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করো :
হে জীবন, হে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ ।
টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী ।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি ।
তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি তো মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও ।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় তোমার মুখেতে অন্ন, বহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই ॥
সারমর্ম
এই কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ছাড়পত্র”(১৯৪৮) এর অন্তর্ভুক্ত । বামপন্থী মনোভাবাপন্ন সুকান্তের কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সাম্যবাদী চিন্তা,শোষিত-নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র সক্রোধ প্রতিবাদ।যে সময় অন্যান্য তরুণেরা সরল তরল প্রেমের কবিতা লেখে,সে বয়সে সুকান্তের কবিতা আগুন জ্বেলে দিচ্ছে অসাম্যের বিরুদ্ধে,পূঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে।”বোধন” কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।শোষক ও শাসিতের অবসান কল্পে শোষিত ও শাসিতের জাগরণের কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের “বোধন”
Hridoy
বোধন
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার ।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো ।
ব্যাহত জীবনযাত্রা, চুপি চুপি কান্না বও বুকে,
হে নীড়-বিহারী সঙ্গী ! আজ শুধু মনে মনে ধুঁকে
ভেবেছ সংসারসিন্ধু কোনোমতে হয়ে যাবে পার
পায়ে পায়ে বাধা ঠেলে । তবু আজো বিস্ময় আমার –
ধূর্ত, প্রবঞ্চক যারা কেড়েছে মুখের শেষ গ্রাস
তাদের করেছ ক্ষমা, ডেকেছ নিজের সর্বনাশ ।
তোমার ক্ষেতের শস্য
চুরি ক’রে যারা গুপ্তকক্ষতে জমায়
তাদেরি দুপায়ে প্রাণ ঢেলে দিলে দুঃসহ ক্ষমায়;
লোভের পাপের দুর্গ গম্বুজ ও প্রাসাদে মিনারে
তুমি যে পেতেছ হাত; আজ মাথা ঠুকে বারে বারে
অভিশাপ দাও যদি, বারংবার হবে তা নিষ্ফল –
তোমার অন্যায়ে জেনো এ অন্যায় হয়েছে প্রবল ।
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে –
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফের দুর্বিপাকে ।
পৃথিবী উদাস, শোনো হে দুনিয়াদার !
সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু-কালো পাহাড়
দগ্ধ হৃদয়ে যদিও ফেরাও ঘাড়
সামনে পেছনে কোথাও পাবে না পার :
কি করে খুলবে মৃত্যু-ঠেকানো দ্বার –
এই মুহূর্তে জবাব দেবে কি তার ?
লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম
অনেক দিয়েছি; উজাড় গ্রাম ।
সুদ ও আসলে আজকে তাই
যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই ।
কৃপণ পৃথিবী, লোভের অস্ত্র
দিয়ে কেড়ে নেয় অন্নবস্ত্র,
লোলুপ রসনা মেলা পৃথিবীতে
বাড়াও ও-হাত তাকে ছিঁড়ে নিতে ।
লোভের মাথায় পদাঘাত হানো-
আনো, রক্তের ভাগীরথী আনো ।
দৈত্যরাজের যত অনুচর
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পর পর;
মেলো চোখ আজ ভাঙো সে ফাঁদ-
হাঁকো দিকে দিকে সিংহনাদ ।
তোমার ফসল, তোমার মাটি
তাদের জীয়ন ও মরণকাঠি
তোমার চেতনা চালিত হাতে ।
এখনও কাঁপবে আশঙ্কাতে ?
স্বদেশপ্রেমের ব্যাঙ্গমা পাখি
মারণমন্ত্র বলে, শোনো তা কি ?
এখনো কি তুমি আমি স্বতন্ত্র ?
করো আবৃত্তি, হাঁকো সে মন্ত্র :
শোন্ রে মালিক, শোন্রে মজুতদার !
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়-
হিসাব কি দিবি তার ?
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলতে পারি ?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই ।
শোন্ রে মজুতদার,
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
করব তোকে এবার ।
তারপর বহুশত যুগ পরে
ভবিষ্যতের কোনো যাদুঘরে
নৃতত্ত্ববিদ্ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার,
মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার ।
তেরোশো সালের মধ্যবর্তী মালিক, মজুতদার
মানুষ ছিল কি ? জবাব মেলে না তার ।
আজ আর বিমূঢ় আস্ফালন নয়,
দিগন্তে প্রত্যাসন্ন সর্বনাশের ঝড়;
আজকের নৈঃশব্দ্য হোক যুদ্ধারম্ভের স্বীকৃতি ।
দু হাতে বাজাও প্রতিশোধের উন্মত্ত দামামা,
প্রার্থনা করো :
হে জীবন, হে যুগ-সন্ধিকালের চেতনা-
আজকে শক্তি দাও, যুগ যুগ বাঞ্ছিত দুর্দমনীয় শক্তি,
প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের
তুষার-গলানো উত্তাপ ।
টুকরো টুকরো ক’রে ছেঁড়ো তোমার
অন্যায় আর ভীরুতার কলঙ্কিত কাহিনী ।
শোষক আর শাসকের নিষ্ঠুর একতার বিরুদ্ধে
একত্রিত হোক আমাদের সংহতি ।
তা যদি না হয় মাথার উপরে ভয়ঙ্কর
বিপদ নামুক, ঝড়ে বন্যায় ভাঙুক ঘর;
তা যদি না হয়, বুঝবো তুমি তো মানুষ নও-
গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও ।
ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয় নি জল
দেয় তোমার মুখেতে অন্ন, বহুতে বল
পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই
ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাঁই ॥
সারমর্ম
এই কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ছাড়পত্র”(১৯৪৮) এর অন্তর্ভুক্ত । বামপন্থী মনোভাবাপন্ন সুকান্তের কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সাম্যবাদী চিন্তা,শোষিত-নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র সক্রোধ প্রতিবাদ।যে সময় অন্যান্য তরুণেরা সরল তরল প্রেমের কবিতা লেখে,সে বয়সে সুকান্তের কবিতা আগুন জ্বেলে দিচ্ছে অসাম্যের বিরুদ্ধে,পূঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে।”বোধন” কবিতাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।শোষক ও শাসিতের অবসান কল্পে শোষিত ও শাসিতের জাগরণের কবিতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের “বোধন”