ক্যামেলিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম তার কমলা,দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।কোলে তার ছিল বই আর খাতা।যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।এখন থেকে সময়ের হিসাবRead more
ক্যামেলিয়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।
এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই–
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না,
প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক্,
ও তো আমার সহযাত্রিণী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝক্ঝক্ করছে যেন।
সুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা,
উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি নিঃসংকোচ।
মনে ভাবি একটা কোনো সংকট দেখা দেয় না কেন,
উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি–
রাস্তার মধ্যে একটা কোনো উৎপাত,
কোনো-একজন গুণ্ডার স্পর্ধা।
এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে।
কিন্তু আমার ভাগ্যটা যেন ঘোলা জলের ডোবা,
বড়ো রকম ইতিহাস ধরে না তার মধ্যে,
নিরীহ দিনগুলো ব্যাঙের মতো একঘেয়ে ডাকে–
না সেখানে হাঙর-কুমিরের নিমন্ত্রণ, না রাজহাঁসের।
একদিন ছিল ঠেলাঠেলি ভিড়।
কমলার পাশে বসেছে একজন আধা-ইংরেজ।
ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে,
ঘাড়ে ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে।
কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশ্পিশ্ করে।
এমন সময়ে সে এক মোটা চুরোট ধরিয়ে
টানতে করলে শুরু।
কাছে এসে বললুম, “ফেলো চুরোট।’
যেন পেলেই না শুনতে,
ধোঁওয়া ওড়াতে লাগল বেশ ঘোরালো করে।
মুখ থেকে টেনে ফেলে দিলেম চুরোট রাস্তায়।
হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার তাকালো কট্মট্ ক’রে–
আর কিছু বললে না, এক লাফে নেমে গেল।
বোধ হয় আমাকে চেনে।
আমার নাম আছে ফুটবল খেলায়,
বেশ একটু চওড়া গোছের নাম।
লাল হয়ে উঠল মেয়েটির মুখ,
বই খুলে মাথা নিচু করে ভান করলে পড়বার।
হাত কাঁপতে লাগল,
কটাক্ষেও তাকালে না বীরপুরুষের দিকে।
আপিসের বাবুরা বললে, “বেশ করেছেন মশায়।’
একটু পরেই মেয়েটি নেমে পড়ল অজায়গায়,
একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেল চলে।
পরদিন তাকে দেখলুম না,
তার পরদিনও না,
তৃতীয় দিনে দেখি
একটা ঠেলাগাড়িতে চলেছে কলেজে।
বুঝলুম, ভুল করেছি গোঁয়ারের মতো।
ও মেয়ে নিজের দায় নিজেই পারে নিতে,
আমাকে কোনো দরকারই ছিল না।
আবার বললুম মনে মনে,
ভাগ্যটা ঘোলা জলের ডোবা–
বীরত্বের স্মৃতি মনের মধ্যে কেবলই আজ আওয়াজ করছে
কোলাব্যাঙের ঠাট্টার মতো।
ঠিক করলুম ভুল শোধরাতে হবে।
খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিঙে।
সেবার আমারও হাওয়া বদলাবার জরুরি দরকার।
ওদের ছোট্ট বাসা, নাম দিয়েছে মতিয়া–
রাস্তা থেকে একটু নেমে এক কোণে
গাছের আড়ালে,
সামনে বরফের পাহাড়।
শোনা গেল আসবে না এবার।
ফিরব মনে করছি এমন সময়ে আমার এক ভক্তের সঙ্গে দেখা,
মোহনলাল–
রোগা মানুষটি, লম্বা, চোখে চশমা,
দুর্বল পাকযন্ত্র দার্জিলিঙের হাওয়ায় একটু উৎসাহ পায়।
সে বললে, “তনুকা আমার বোন,
কিছুতে ছাড়বে না তোমার সঙ্গে দেখা না করে।’
মেয়েটি ছায়ার মতো,
দেহ যতটুকু না হলে নয় ততটুকু–
যতটা পড়াশোনায় ঝোঁক, আহারে ততটা নয়।
ফুটবলের সর্দারের ‘পরে তাই এত অদ্ভুত ভক্তি–
মনে করলে আলাপ করতে এসেছি সে আমার দুর্লভ দয়া।
হায় রে ভাগ্যের খেলা!
যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
“একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা–
একটি ফুলের গাছ।’
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, “দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।’
জিগেস করলেম, “নামটা কী?’
সে বললে “ক্যামেলিয়া’।
চমক লাগল–
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, “ক্যামেলিয়া,
সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’
তনুকা কী বুঝলে জানি নে, হঠাৎ লজ্জা পেলে,
খুশিও হল।
চললেম টবসুদ্ধ গাছ নিয়ে।
দেখা গেল পার্শ্ববর্তিনী হিসাবে সহযাত্রিণীটি সহজ নয়।
একটা দো-কামরা গাড়িতে
টবটাকে লুকোলেম নাবার ঘরে।
থাক্ এই ভ্রমণবৃত্তান্ত,
বাদ দেওয়া যাক আরো মাস কয়েকের তুচ্ছতা।
পুজোর ছুটিতে প্রহসনের যবনিকা উঠল
সাঁওতাল পরগনায়।
জায়গাটা ছোটো। নাম বলতে চাই নে–
বায়ুবদলের বায়ু-গ্রস্তদল এ জায়গার খবর জানে না।
কমলার মামা ছিলেন রেলের এঞ্জিনিয়র।
এইখানে বাসা বেঁধেছেন
শালবনে ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের পাড়ায়।
সেখানে নীল পাহাড় দেখা যায় দিগন্তে,
অদূরে জলধারা চলেছে বালির মধ্যে দিয়ে,
পলাশবনে তসরের গুটি ধরেছে,
মহিষ চরছে হর্তকি গাছের তলায়–
উলঙ্গ সাঁওতালের ছেলে পিঠের উপরে।
বাসাবাড়ি কোথাও নেই,
তাই তাঁবু পাতলেম নদীর ধারে।
সঙ্গী ছিল না কেউ,
কেবল ছিল টবে সেই ক্যামেলিয়া।
কমলা এসেছে মাকে নিয়ে।
রোদ ওঠবার আগে
হিমে-ছোঁওয়া স্নিগ্ধ হাওয়ায়
শাল-বাগানের ভিতর দিয়ে বেড়াতে যায় ছাতি হাতে।
মেঠো ফুলগুলো পায়ে এসে মাথা কোটে,
কিন্তু সে কি চেয়ে দেখে।
অল্পজল নদী পায়ে হেঁটে
পেরিয়ে যায় ও পারে,
সেখানে সিসুগাছের তলায় বই পড়ে।
আর আমাকে সে যে চিনেছে
তা জানলেম আমাকে লক্ষ্য করে না বলেই।
একদিন দেখি নদীর ধারে বালির উপর চড়িভাতি করছে এরা।
ইচ্ছে হল গিয়ে বলি, আমাকে দরকার কি নেই কিছুতেই।
আমি পারি জল তুলে আনতে নদী থেকে–
পারি বন থেকে কাঠ আনতে কেটে,
আর, তা ছাড়া কাছাকাছি জঙ্গলের মধ্যে
একটা ভদ্রগোছের ভালুকও কি মেলে না।
দেখলেম দলের মধ্যে একজন যুবক–
শট্-পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা,
কমলার পাশে পা ছড়িয়ে
হাভানা চুরোট খাচ্ছে।
আর, কমলা অন্যমনে টুকরো টুকরো করছে
একটা শ্বেতজবার পাপড়ি,
পাশে পড়ে আছে
বিলিতি মাসিক পত্র।
মুহূর্তে বুঝলেম এই সাঁওতাল পরগনার নির্জন কোণে
আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও।
তখনি চলে যেতেম, কিন্তু বাকি আছে একটি কাজ।
আর দিন-কয়েকেই ক্যামেলিয়া ফুটবে,
পাঠিয়ে দিয়ে তবে ছুটি।
সমস্ত দিন বন্দুক ঘাড়ে শিকারে ফিরি বনে জঙ্গলে,
সন্ধ্যার আগে ফিরে এসে টবে দিই জল
আর দেখি কুঁড়ি এগোল কত দূর।
সময় হয়েছে আজ।
যে আনে আমার রান্নার কাঠ।
ডেকেছি সেই সাঁওতাল মেয়েটিকে।
তার হাত দিয়ে পাঠাব
শালপাতার পাত্রে।
তাঁবুর মধ্যে বসে তখন পড়ছি ডিটেকটিভ গল্প।
বাইরে থেকে মিষ্টিসুরে আওয়াজ এল, “বাবু, ডেকেছিস কেনে।’
বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া
সাঁওতাল মেয়ের কানে,
কালো গালের উপর আলো করেছে।
সে আবার জিগেস করলে, “ডেকেছিস কেনে।’
আমি বললেম, “এইজন্যেই।’
তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।
In English Font:
Camellia
Rabindranath Tagore
Tar naam Komola
Dekhechi tar khatar upore lekha.
se cholechilo trame, tar bhai ke niye colleger rastay
Ami chilem pichoner benchite.
Mukher ek pasher nitol rekhati deka jay,
Ar gader upor kumol chulguli khupar niche.
Kole tar chilo boi ar khata.
jekhane amar nambar shekhane nama holo na.
Ekhon theke somoyer hishab kore beroi-
Se hishab amar kajer songe thikti mele na ,
pray thik mele oder berobar somoyer songe,
prai e hoy dekha.
Mone mone bhabi, aar-kuno shmmondho na thak,
O to amar shohojatrini.
Nirmal buddhir chehara
jhakjhak korche jeno.
Sukumar kopal theke chul upore tula,
ujjal chokher dristi nishonkoch.
Mone bhavi ekta kono shonkot dekha jay na keno,
Uddhar kore janmo sharthok kori
Rastar moddhe ekta kono utpat
Kono ekjon gundar spordha.
Emon to aajkal ghotei thake
Kintu amar vagyota jeno ghula joler duba
Boro rokom itihash dhore na tar moddhe
niriho dingulo benger moto ekgeye dake
Na shekhane hangor-kumirer niyontron, na rajhasher.
Ekdin chilo theltheli bhir.
Komolar pashe boseche ekjon adha Engraj
Icche korchilo, okarone tupita uriye dei tar matha theke,
Ghare dhore take rastay di namiye.
Kuno chut pai ne, Hath nimpish kore.
Emon shomoye she ek mota churot dhoriye
Tante korle shuru.
Kache eshe Bollum, “Felo churot”.
Jeno pelei na shunte,
Dhuwa orate laglo besh ghuralo kore.
Mukh theke tene fele dilem churot rastay
Hath mutho pakiye ekbar takalo kotakkho kore
Ar kichu bolle na, ek lafe neme gele
Budh hoy amake chine.
Amar naam aache football khelay,
Besh ektu chora gocher naam.
Lal hoye uthlo meyetir mukh,
Boi khule matha nichu kore van korle porbar
hath kaple laglo,
kotakkheo takale na birpurusher dike.
Aapisher babura bolle, “Besh korechen moshay”
ektu porei neme porlo ojaygay,
Ekta taxi niye chole gelo
Hridoy
নিষ্কৃতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মা কেঁদে কয়, "'মঞ্জুলী মোর ঐ তো কচি মেয়ে, ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে?--বয়সে ওর চেয়ে পাঁচগুনো সে বড়ো;-- তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড়। এমন বিয়ে ঘটতে দেব নাকো।" বাপ বললে, "কান্না তোমার রাখো! পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে, জান না কি মস্ত কুলীন ও যে। সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কিRead more
নিষ্কৃতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মা কেঁদে কয়, “‘মঞ্জুলী মোর ঐ তো কচি মেয়ে,
ওরি সঙ্গে বিয়ে দেবে?–বয়সে ওর চেয়ে
পাঁচগুনো সে বড়ো;–
তাকে দেখে বাছা আমার ভয়েই জড়সড়।
এমন বিয়ে ঘটতে দেব নাকো।”
বাপ বললে, “কান্না তোমার রাখো!
পঞ্চাননকে পাওয়া গেছে অনেক দিনের খোঁজে,
জান না কি মস্ত কুলীন ও যে।
সমাজে তো উঠতে হবে সেটা কি কেউ ভাব।
ওকে ছাড়লে পাত্র কোথায় পাব।”
মা বললে, “কেন ঐ যে চাটুজ্যেদের পুলিন,
নাই বা হল কুলীন,–
দেখতে যেমন তেমনি স্বভাবখানি,
পাস করে ফের পেয়েছে জলপানি,
সোনার টুকরো ছেলে।
এক-পাড়াতে থাকে ওরা–ওরি সঙ্গে হেসে খেলে
মেয়ে আমার মানুষ হল; ওকে যদি বলি আমি আজই
এক্খনি হয় রাজি।”
বাপ বললে, “থামো,
আরে আরে রামোঃ।
ওরা আছে সমাজের সব তলায়।
বামুন কি হয় পৈতে দিলেই গলায়?
দেখতে শুনতে ভালো হলেই পাত্র হল! রাধে!
স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে।”
যেদিন ওরা গিনি দিয়ে দেখলে কনের মুখ
সেদিন থেকে মঞ্জুলিকার বুক
প্রতি পলের গোপন কাঁটায় হল রক্তে মাখা।
মায়ের স্নেহ অন্তর্যামী, তার কাছে তো রয় না কিছুই ঢাকা;
মায়ের ব্যথা মেয়ের ব্যথা চলতে খেতে শুতে
ঘরের আকাশ প্রতিক্ষণে হানছে যেন বেদনা-বিদ্যুতে।
অটলতার গভীর গর্ব বাপের মনে জাগে,–
সুখে দুঃখে দ্বেষে রাগে
ধর্ম থেকে নড়েন তিনি নাই হেন দৌর্বল্য।
তাঁর জীবনের রথের চাকা চলল
লোহার বাঁধা রাস্তা দিয়ে প্রতিক্ষণেই,
কোনোমতেই ইঞ্চিখানেক এদিক-ওদিক একটু হবার জো নেই।
তিনি বলেন, তাঁর সাধনা বড়োই সুকঠোর,
আর কিছু নয়, শুধুই মনের জোর,
অষ্টাবক্র জমদগ্নি প্রভৃতি সব ঋষির সঙ্গে তুল্য,
মেয়েমানুষ বুঝবে না তার মূল্য।
অন্তঃশীলা অশ্রুনদীর নীরব নীরে
দুটি নারীর দিন বয়ে যায় ধীরে।
অবশেষে বৈশাখে এক রাতে
মঞ্জুলিকার বিয়ে হল পঞ্চাননের সাথে।
বিদায়বেলায় মেয়েকে বাপ বলে দিলেন মাথায় হস্ত ধরি
“হও তুমি সাবিত্রীর মতো এই কামনা করি।”
কিমাশ্চর্যমতঃপরং, বাপের সাধন-জোরে
আশীর্বাদের প্রথম অংশ দু-মাস যেতেই ফলল কেমন করে–
পঞ্চাননকে ধরল এসে যমে;
কিন্তু মেয়ের কপালক্রমে
ফলল না তার শেষের দিকটা, দিলে না যম ফিরে,
মঞ্জুলিকা বাপের ঘরে ফিরে এল সিঁদুর মুছে শিরে।
দুঃখে সুখে দিন হয়ে যায় গত
স্রোতের জলে ঝরে-পড়া ভেসে-যাওয়া ফুলের মতো,
অবশেষে হল
মঞ্জুলিকার বয়স ভরা ষোলো।
কখন শিশুকালে
হৃদয়-লতার পাতার অন্তরালে
বেরিয়েছিল একটি কুঁড়ি
প্রাণের গোপন রহস্যতল ফুঁড়ি;
জানত না তো আপনাকে সে,
শুধায় নি তার নাম কোনোদিন বাহির হতে খেপা বাতাস এসে,
সেই কুঁড়ি আজ অন্তরে তার উঠছে ফুটে
মধুর রসে ভরে উঠে’।
সে যে প্রেমের ফুল
আপনি রাঙা পাপড়িভারে আপনি সমাকুল।
আপনাকে তার চিনতে যে আর নাইকো বাকি,
তাইতো থাকি থাকি
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে।
আকাশপারের বাণী তারে ডাক দিয়ে যায় আলোর ঝরনা বেয়ে;
রাতের অন্ধকারে
কোন্ অসীমের রোদনভরা বেদন লাগে তারে।
বাহির হতে তার
ঘুচে গেছে সকল অলংকার;
অন্তর তার রাঙিয়ে ওঠে স্তরে স্তরে,
তাই দেখে সে আপনি ভেবে মরে।
কখন কাজের ফাঁকে
জানলা ধরে চুপ করে সে বাইরে চেয়ে থাকে–
যেখানে ওই শজনে গাছের ফুলের ঝুরি বেড়ার গায়ে
রাশি রাশি হাসির ঘায়ে
আকাশটারে পাগল করে দিবসরাতি।
যে ছিল তার ছেলেবেলার খেলাঘরের সাথি
আজ সে কেমন করে
জলস্থলের হৃদয়খানি দিল ভরে।
অরূপ হয়ে সে যেন আজ সকল রূপে রূপে
মিশিয়ে গেল চুপে চুপে।
পায়ের শব্দ তারি
মরমরিত পাতায় পাতায় গিয়েছে সঞ্চারি।
কানে কানে তারি করুণ বাণী
মৌমাছিদের পাখার গুনগুনানি।
মেয়ের নীরব মুখে
কী দেখে মা, শেল বাজে তার বুকে।
না-বলা কোন্ গোপন কথার মায়া
মঞ্জুলিকার কালো চোখে ঘনিয়ে তোলে জলভরা এক ছায়া;
অশ্রু-ভেজা গভীর প্রাণের ব্যথা
এনে দিল অধরে তার শরৎনিশির স্তব্ধ ব্যাকুলতা।
মায়ের মুখে অন্ন রোচে নাকো–
কেঁদে বলে, “হায় ভগবান, অভাগীরে ফেলে কোথায় থাক।”
একদা বাপ দুপুরবেলায় ভোজন সাঙ্গ করে
গুড়গুড়িটার নলটা মুখে ধরে,
ঘুমের আগে, যেমন চিরাভ্যাস,
পড়তেছিলেন ইংরেজি এক প্রেমের উপন্যাস।
মা বললেন, বাতাস করে গায়ে,
কখনো বা হাত বুলিয়ে পায়ে,
“যার খুশি সে নিন্দে করুক, মরুক বিষে জ্বরে
আমি কিন্তু পারি যেমন ক’রে
মঞ্জুলিকার দেবই দেব বিয়ে।”
বাপ বললেন, কঠিন হেসে, “তোমরা মায়ে ঝিয়ে
এক লগ্নেই বিয়ে ক’রো আমার মরার পরে,
সেই কটা দিন থাকো ধৈর্য ধরে।”
এই বলে তাঁর গুড়গুড়িতে দিলেন মৃদু টান।
মা বললেন, “‘উঃ কী পাষাণ প্রাণ,
স্নেহমায়া কিচ্ছু কি নেই ঘটে।”
বাপ বললেন, “আমি পাষাণ বটে।
ধর্মের পথ কঠিন বড়ো, ননির পুতুল হলে
এতদিনে কেঁদেই যেতেম গলে।”
মা বললেন, “হায় রে কপাল। বোঝাবই বা কারে।
তোমার এ সংসারে
ভরা ভোগের মধ্যখানে দুয়ার এঁটে
পলে পলে শুকিয়ে মরবে ছাতি ফেটে
একলা কেবল একটুকু ঐ মেয়ে,
ত্রিভুবনে অধর্ম আর নেই কিছু এর চেয়ে।
তোমার পুঁথির শুকনো পাতায় নেই তো কোথাও প্রাণ,
দরদ কোথায় বাজে সেটা অন্তর্যামী জানেন ভগবান।”
বাপ একটু হাসল কেবল, ভাবলে, “মেয়েমানুষ
হৃদয়তাপের ভাপে-ভরা ফানুস।
জীবন একটা কঠিন সাধন–নেই সে ওদের জ্ঞান।”
এই বলে ফের চলল পড়া ইংরেজি সেই প্রেমের উপাখ্যান।
দুখের তাপে জ্বলে জ্বলে অবশেষে নিবল মায়ের তাপ;
সংসারেতে একা পড়লেন বাপ।
বড়ো ছেলে বাস করে তার স্ত্রীপুত্রদের সাথে
বিদেশে পাটনাতে।
দুই মেয়ে তার কেউ থাকে না কাছে,
শ্বশুরবাড়ি আছে।
একটি থাকে ফরিদপুরে,
আরেক মেয়ে থাকে আরো দূরে
মাদ্রাজে কোন্ বিন্ধ্যগিরির পার।
পড়ল মঞ্জুলিকার ‘পরে বাপের সেবাভার।
রাঁধুনে ব্রাহ্মণের হাতে খেতে করেন ঘৃণা,
স্ত্রীর রান্না বিনা
অন্নপানে হত না তার রুচি।
সকালবেলায় ভাতের পালা, সন্ধ্যাবেলায় রুটি কিংবা লুচি;
ভাতের সঙ্গে মাছের ঘটা
ভাজাভুজি হত পাঁচটা-ছটা;
পাঁঠা হত রুটি-লুচির সাথে।
মঞ্জুলিকা দুবেলা সব আগাগোড়া রাঁধে আপন হাতে।
একাদশী ইত্যাদি তার সকল তিথিতেই
রাঁধার ফর্দ এই।
বাপের ঘরটি আপনি মোছে ঝাড়ে
রৌদ্রে দিয়ে গরম পোশাক আপনি তোলে পাড়ে।
ডেস্কে বাক্সে কাগজপত্র সাজায় থাকে থাকে,
ধোবার বাড়ির ফর্দ টুকে রাখে।
গয়লানী আর মুদির হিসাব রাখতে চেষ্টা করে,
ঠিক দিতে ভুল হলে তখন বাপের কাছে ধমক খেয়ে মরে।
কাসুন্দি তার কোনোমতেই হয় না মায়ের মতো,
তাই নিয়ে তার কত
নালিশ শুনতে হয়।
তা ছাড়া তার পান-সাজাটা মনের মতো নয়।
মায়ের সঙ্গে তুলনাতে পদেপদেই ঘটে যে তার ত্রুটি।
মোটামুটি–
আজকালকার মেয়েরা কেউ নয় সেকালের মতো।
হয়ে নীরব নত,
মঞ্জুলী সব সহ্য করে, সর্বদাই সে শান্ত,
কাজ করে অক্লান্ত।
যেমন করে মাতা বারংবার
শিশু ছেলের সহস্র আবদার
হেসে সকল বহন করেন স্নেহের কৌতুকে,
তেমনি করেই সুপ্রসন্ন মুখে
মঞ্জুলী তার বাপের নালিশ দন্ডে দন্ডে শোনে,
হাসে মনে মনে।
বাবার কাছে মায়ের স্মৃতি কতই মূল্যবান
সেই কথাটা মনে ক’রে গর্বসুখে পূর্ণ তাহার-প্রাণ।
“আমার মায়ের যত্ন যে-জন পেয়েছে একবার
আর-কিছু কি পছন্দ হয় তার।”
হোলির সময় বাপকে সেবার বাতে ধরল ভারি।
পাড়ায় পুলিন করছিল ডাক্তারি,
ডাকতে হল তারে।
হৃদয়যন্ত্র বিকল হতে পারে
ছিল এমন ভয়।
পুলিনকে তাই দিনের মধ্যে বারেবারেই আসতে যেতে হয়।
মঞ্জুলী তার সনে
সহজভাবেই কইবে কথা যতই করে মনে
ততই বাধে আরো।
এমন বিপদ কারো
হয় কি কোনোদিন।
গলাটি তার কাঁপে কেন, কেন এতই ক্ষীণ,
চোখের পাতা কেন
কিসের ভারে জড়িয়ে আসে যেন।
ভয়ে মরে বিরহিণী
শুনতে যেন পাবে কেহ রক্তে যে তা’র বাজে রিনিরিনি।
পদ্মপাতায় শিশির যেন, মনখানি তার বুকে
দিবারাত্রি টলছে কেন এমনতরো ধরা-পড়ার মুখে।
ব্যামো সেরে আসছে ক্রমে,
গাঁঠের ব্যথা অনেক এল কমে।
রোগী শয্যা ছেড়ে
একটু এখন চলে হাত-পা নেড়ে।
এমন সময় সন্ধ্যাবেলা
হাওয়ায় যখন যূথীবনের পরানখানি মেলা,
আঁধার যখন চাঁদের সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে
চুপ ক’রে শেষ তাকিয়ে থাকে চেয়ে,
তখন পুলিন রোগী-সেবার পরামর্শ-ছলে
মঞ্জুলিরে পাশের ঘরে ডেকে বলে–
“জান তুমি তোমার মায়ের সাধ ছিল এই চিতে
মোদের দোঁহার বিয়ে দিতে।
সে ইচ্ছাটি তাঁরি
পুরাতে চাই যেমন করেই পারি।
এমন করে আর কেন দিন কাটাই মিছিমিছি।”
“না না, ছি ছি, ছি ছি।”
এই ব’লে সে মঞ্জুলিকা দু-হাত দিয়ে মুখখানি তার ঢেকে
ছুটে গেল ঘরের থেকে।
আপন ঘরে দুয়ার দিয়ে পড়ল মেঝের ‘পরে–
ঝরঝরিয়ে ঝরঝরিয়ে বুক ফেটে তার অশ্রু ঝরে পড়ে।
ভাবলে, “পোড়া মনের কথা এড়ায় নি ওঁর চোখ।
আর কেন গো। এবার মরণ হ’ক।”
মঞ্জুলিকা বাপের সেবায় লাগল দ্বিগুণ ক’রে
অষ্টপ্রহর ধরে।
আবশ্যকটা সারা হলে তখন লাগে অনাবশ্যক কাজে,
যে-বাসনটা মাজা হল আবার সেটা মাজে।
দু-তিন ঘন্টা পর
একবার যে-ঘর ঝেড়েছে ফের ঝাড়ে সেই ঘর।
কখন যে স্নান, কখন যে তার আহার,
ঠিক ছিল না তাহার।
কাজের কামাই ছিল নাকো যতক্ষণ না রাত্রি এগারোটায়
শ্রান্ত হয়ে আপনি ঘুমে মেঝের ‘পরে লোটায়।
যে দেখল সে-ই অবাক হয়ে রইল চেয়ে,
বললে, “ধন্যি মেয়ে।”
বাপ শুনে কয় বুক ফুলিয়ে, “গর্ব করি নেকো,
কিন্তু তবু আমার মেয়ে সেটা স্মরণ রেখো।
ব্রহ্মচর্য- ব্রত
আমার কাছেই শিক্ষা যে ওর। নইলে দেখতে অন্যরকম হ’ত।
আজকালকার দিনে
সংযমেরি কঠোর সাধন বিনে
সমাজেতে রয় না কোনো বাঁধ,
মেয়েরা তাই শিখছে কেবল বিবিয়ানার ছাঁদ।”
স্ত্রীর মরণের পরে যবে
সবেমাত্র এগারো মাস হবে,
গুজব গেল শোনা
এই বাড়িতে ঘটক করে আনাগোনা।
প্রথম শুনে মঞ্জুলিকার হয় নিকো বিশ্বাস,
তার পরে সব রকম দেখে ছাড়লে নিশ্বাস।
ব্যস্ত সবাই, কেমনতরো ভাব
আসছে ঘরে নানা রকম বিলিতি আসবাব।
দেখলে বাপের নতুন করে সাজসজ্জা শুরু,
হঠাৎ কালো ভ্রমরকৃষ্ণ ভুরু,
পাকাচুল সব কখন হল কটা,
চাদরেতে যখন-তখন গন্ধ মাখার ঘটা।
মার কথা আজ মঞ্জুলিকার পড়ল মনে
বুকভাঙা এক বিষম ব্যথার সনে।
হ’ক না মৃত্যু, তবু
এ-বাড়ির এই হাওয়ার সঙ্গে বিরহ তাঁর ঘটে নাই তো কভু।
কল্যাণী সেই মূর্তিখানি সুধামাখা
এ সংসারের মর্মে ছিল আঁকা;
সাধ্বীর সেই সাধনপুণ্য ছিল ঘরের মাঝে,
তাঁরি পরশ ছিল সকল কাজে।
এ সংসারে তাঁর হবে আজ পরম মৃত্যু, বিষম অপমান–
সেই ভেবে যে মঞ্জুলিকার ভেঙে পড়ল প্রাণ।
ছেড়ে লজ্জাভয়
কন্যা তখন নিঃসংকোচে কয়
বাপের কাছে গিয়ে,–
“তুমি নাকি করতে যাবে বিয়ে।
আমরা তোমার ছেলেমেয়ে নাতনী-নাতি যত
সবার মাথা করবে নত?
মায়ের কথা ভুলবে তবে?
তোমার প্রাণ কি এত কঠিন হবে।”
বাবা বললে শুষ্ক হাসে,
“কঠিন আমি কেই বা জানে না সে?
আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠোর কর্ম,
কিন্তু গৃহধর্ম
স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়
মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়।
সহজ তো নয় ধর্মপথে হাঁটা,
এ তো কেবল হৃদয় নিয়ে নয়কো কাঁদাকাটা।
যে করে ভয় দুঃখ নিতে দুঃখ দিতে
সে কাপুরুষ কেনই আসে পৃথিবীতে।”
বাখরগঞ্জে মেয়ের বাপের ঘর।
সেথায় গেলেন বর
বিয়ের কদিন আগে, বৌকে নিয়ে শেষে
যখন ফিরে এলেন দেশে
ঘরেতে নেই মঞ্জুলিকা। খবর পেলেন চিঠি পড়ে
পুলিন তাকে বিয়ে করে
গেছে দোঁহা ফরাক্কাবাদ চলে,
সেইখানেতে ঘর পাতবে ব’লে।
আগুন হয়ে বাপ
বারে বারে দিলেন অভিশাপ।
In English Font:
Nishkriti
Rabindranath Tagore
Ma kede koy, “‘manjuli mor ai to koci meye,
Ori sange biye debe?–Boyoshe or cheye
Pachguno se boṛo;–
Take dekhe bacha amar bhaye’i jaṛasaṛa.
Emani biye ghaṭ te debe nako.”
Bap bolle, “kanna tomar rakho!
Pancanan ke pawa geche anek diner khoje,
Jano na ki masta kulina o je.
Samaje to uṭh-te hobe seṭa ki ke’u bhabo.
Oke chaṛle patra kothay pabo.”
Ma bolle, “keno ai je chatudera pulin,
Na’i ba halo kulin,–
Dekhte jemon temon sbabhbakhani,
Pash kare pher peyeche jalpani,
Sonar ṭukro chele.
Ek-paṛate thake ora–ori saṅge heshe khele
Meye amar manuṣh holo; oke jadi boli ami aji
Ekhoni hoy raji.”
Bap bolle, “thamo,
Are are Ramo.
Ora ache samajer sab talay.
Bamun ki hoy paite dile’i galay?
Dekhte śunte bhalo hole’i patra holo! Radhe!
Sribud’dhi ki śastre bole sadhe.”
Jedin ora gini diye dekhle koner mukh
Sedina theke manjulikar buk
Prati poler gopan kaṭay holo rakte makha.
Mayer sneho antarjamī, tar kache to roy na kichu’i ḍhaka;
Mayer byatha meyer byatha cholte khete śute
Gharer akash pratikhaṇe hanche jeno bedana-bidyute.
Aṭalatar gabhīr garba baper mon jage,-
Sukhe dukhe dbeṣhe rage
Dharma theke naṛen tini na’i heno daurbolya.
Tar jīboner rather chaka chollo
lohar badha rasta diye pratikhane e
konomate’i incikhanek edik-odik ekṭu habar jo ne’i.