( Note 😉:- কারো জন্য ইতিহাস তিতা তো কারো জন্য মিঠা হয়।তিতা লাগলে দয়া করে আবার তিতা কমেন্ট করবেন না।আমি মিষ্টি মানুষ😝।) 🧐সুলতান মাহমুদ গজনভি,ইতিহাসে বহু বিতর্কিত এক ব্যাক্তিত্ব।মুসলমানদের নিকট তিনি "গাজী"।অনেকের মতে যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পৌত্তলিকদের ধ্বংস করা।আবার ভারতের হিন্দু সমাজের কাছে তিনি ছিRead more
(
Note 😉:- কারো জন্য ইতিহাস তিতা তো কারো জন্য মিঠা হয়।তিতা লাগলে দয়া করে আবার তিতা কমেন্ট করবেন না।আমি মিষ্টি মানুষ😝।)
🧐সুলতান মাহমুদ গজনভি,ইতিহাসে বহু বিতর্কিত এক ব্যাক্তিত্ব।মুসলমানদের নিকট তিনি “গাজী”।অনেকের মতে যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পৌত্তলিকদের ধ্বংস করা।আবার ভারতের হিন্দু সমাজের কাছে তিনি ছিলেন এক অসুর।যিনি কুগ্রহের মতই হঠাৎ উদিত হন।হুনদের মত তাকে ভাবা হতো বর্বর এক লুণ্ঠনকারি।কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করলে তিনি এক আজন্ম নেতা,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুশাসক,ন্যায়পরায়ণ সুবিচারক বিশ্বের অন্যতম এক দক্ষ বিজেতা এবং নৃপতি।অধ্যাপক হাবিব যথার্থই বলেন,”উত্তরসূরিদের কাছে তিনি ছিলেন সত্যই কিংবদন্তি রাজকুমার।সুলতান তার জনগণের নিকট দেবদূত হিসেবে খ্যাত ছিলেন।এইবার আসেন আসল কথায় আসি।
***১:- সুলতান মাহমুদ তার ভারতবিরোধী অভিযান শুরু করেন ১০০০ খ্রিস্টাব্দে।খাইবার পাস সীমান্তের কিছু দুর্গ দখল করে উনি তার সীমান্ত সুরক্ষিত করেন।
***২:-পিতৃশত্রু জয়পালের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১০০১ সালে সুলতান মাহমুদ তার ১০০০০ সেনাদল নিয়ে জয় পালের ১২০০০ ঘোড়সাওয়ার,৩০০০০ পদাতিক এবং ৩০০ হস্তী বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ২,৫০,০০০ দিনার,৫০ টি হাতি ও রাজ্যের কিয়দংশ ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিয়ে পরাজিত জয়পাল কে মুক্তি দেন।
***৩:-১০০৪-১০০৫ খ্রিস্টাব্দে ঝিলম নদীর তীরের ভীরা রাজ্য আক্রমণ করেন এবং তা অধিকার করেন। যা ছিল মূলত তার রাজ্যের সুরক্ষার জন্য।
***৪:-১০০৬ সালে মাহমুদ মুলতানের আবুল ফাতেহ দাউদ এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামলে দাউদ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যায়।এভাবেই মুলতান সুলতান মাহমুদের করতলগত হয়।এটি ছিল তার রাজ্যের বিস্তারের জন্য।
***৫:-১০০৭ সালে আনন্দপালের ছেলে সুখপাল যিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নওরোজ শাহ্ উপাধি নিয়ে ছিলেন তিনি ইসলাম ত্যাগ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।সুলতান ক্ষুদ্ধ হন এবং ভারতে ৫ম অভিযান পরিচালনা করে সুখপালকে পরাজিত ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সুখপালের থেকে ৪০০০০ দিরহাম জরিমানাও আদায় করা হয়।
***৬:-১০০৮ সালে সুলতান মাহমুদ অনন্দপালের বিরুদ্ধে তার ষষ্ঠ অভিযান পরিচালনা করে। আনন্দপাল দিল্লি,কনৌজ, উজ্জৈনি, গোয়ালীয়র ও আজমিরের হিন্দু রাজাদের নিয়ে এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে।কাশ্মীরের খোক্কার জাতি ও যোগ দেয় সেই বাহিনীতে। ভীষন যুদ্ধ হয়।যুদ্ধের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় আনন্দ পালের হস্তী বাহিনীর হাতিগুলো হঠাৎ কেন জানি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।ফলে আনন্দ্পালের শিবিরে গোলযোগ বেঁধে যায়।আর মাহমুদ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যুদ্ধ জিতে যান।**এই যুদ্ধ অবশ্যই ছিল তার কর্তৃত্ব বৃদ্ধির যুদ্ধ।অর্থাৎ,ভারত থেকে গজনীতে যাতে ভবিষ্যতে কেউ হামলা করার সাহস না করে তার পাকা পোক্ত ব্যবস্থা।সুলতান মাহমুদ চাইছিলেন মধ্য এশিয়া তে নিজের সাম্রাজ্য দাঁড় করতে।ভারতের বিজিত রাজ্যগুলো নিজের করলে তার মধ্য এশিয়াতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ব্যাহত হতে পারে এই ভেবে তিনি শুধু পাঞ্জাব বাদে সকল রাজ্যগুলো মোটা অংকের জরিমানা ও রাজাদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে ছেড়ে দেন।
***৭:-১০০৯ সালে সুলতান মাহমুদ কাংড়ার নাগরকোটে অভিযান চালান এবং ঐতিহাসিক ফিরিস্তার মতে,দুর্গ এবং ধ্বংস করা মন্দির থেকে ৭ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা,২শ মণ খাটি সোনা,৭শ মণ রূপার পাত,২ হাজার মণ অপরিশোধিত রূপা এবং ২০ মণ মণি মুক্তা লাভ করেন😲।। এ অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ দেখে সুলতান মাহমুদ নিজেই স্তম্ভিত হন।এই দুর্গে অভিযানের কারন হয় তো এইটাই।তবে এত সম্পদ থাকার কথা সুলতান মাহমুদ নিজেও কল্পনা করতে পারেননি।
***৮:-১০১০ সালে মাহমুদ মুলতানের বিদ্রোহী শাসক দাউদ কে পরাজিত করে শাস্তি প্রদান করেন।
***৯:- এতবার হারার পরেই আমাদের “Robert Bruce” আনন্দপাল হতোদ্যম হননি🤟😏।তিনি নিজের রাজধানী নন্দিতে স্থানান্তর করে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেন।মাহমুদ সেই কথা জানতে পারেন।কিন্তু যুদ্ধ করার আগেই ওপর ওয়ালা আনন্দ পালকে ডেকে নেয়😦।যার দরুন তার পুত্র ত্রিলোচন সিংহাসনে বসে।সিংহাসনে বসেই বেচারা ১০১৪ সালে সুলতান মাহমুদের আক্রমণের শিকার হয়।সে কাশ্মীরে পালিয়ে যায়।কিন্তু ট্রি লোচন😏🤟 ছিল দারুন লেভেলের দাগাবাজ😡।সে তার আশ্রয়দাতা কাশ্মীরের রাজাকে পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করে।কিন্তু কাশ্মীরে না থেকে সে তার পিতৃ রাজ্যে ফিরে এসে শিবলী পাহাড়ে নিজ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে।কিন্তু আবারও মাহমুদের কাছে ধরা খেতে হয় তাকে।।তার পরের কাহিনী অতি সংক্ষিপ্ত,১০২১ এ ট্রি লোচন তার কৃতঘ্নতার শাস্তি পায়।সে গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হয়।এরপর তার ছেলে ভীম রাজা হলেও কয়েক বছর পর মারা যান।এভাবে হিন্দুশাহী বংশের পতন হয়😞।ট্রিলোচনের ক্ষমতা খর্ব করাই তার উদেশ্য ছিল বলে মনে হয়।
***১০:-১০১৪ সালে মাহমুদ থানেস্বর অভিযান চালান। সেখানের হিন্দুগণ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করলেও পরাজিত হন তারা।এরপর মাহমুদ বিখ্যাত চক্রস্বামী মন্দির ধ্বংস করেন এবং সেখানে থাকা অঢেল সম্পদ আর বহুমূল্য ব্রোঞ্জের মূর্তিটি নিয়ে যান।মন্দির ধ্বংস করাই তার উদেশ্য ছিল সম্ভবত।
***১১:- মাহমুদ কাশ্মীর অভিযান চালান দুই বার।তবে প্রচন্ড শীতের কারন দুইবারই ব্যর্থ হন।কারন জানি না।
***১২:-১০১৮ তে মাহমুদ হিন্দুস্তানি সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র বা রাজধানী কনওজ অভিযান চালান।পথে বালান ও বুলন্দ শর এর রাজা হরদত্ত কে পরাজিত করেন, হরদত্ত ১০০০০ লোকসহ ইসলাম গ্রহণ করেন।এরপর বৃন্দাবন ও মথুরায় নিজ আধিপত্য বিস্তার করেন এবং উভয় স্থান হতেই প্রচুর অর্থ সম্পদ দখল করেন।(কিছু মন্দির মনে হয় ধ্বংস করা হইছিলো)।১০১৯ সালে জানুয়ারিতে কনৌজের দরজায় টোকা দেন মাহমুদ।আর এই টোকায় ভয় পেয়ে কনৌজের প্রতিহার রাজ রাজ্যপাল বিনাশর্তে বশ্যতা স্বীকার করে।এই অভিযানে মাহমুদ ৩০ লাখ দিরহাম,৩৫০ টি হাতি,৫৫ হাজার দাস নিয়ে গজনী ফিরে যান।লক্ষ ছিল ভারতের শাসকদের দুর্বল করা এবং কর্তৃত্ব ও তাদের ভেতর ভয় বজায় রাখা।
***১৩:- কনওজ রাজ রাজ্যপাল মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করায় বাকিরা তার ওপর দারুন ক্ষেপে যায়।ভাবতে পারেন,কি খারাপ😡!বিপদে সাহায্য তো করেই না আবার মান মর্যাদা দেখাইতে আসে।তো রাজ্যপাল তার প্রতিবেশী রাজাদের হাতে মারা যায়।এর প্রতিশোধ নিতে ক্রোধ উন্মত্ত সুলতান মাহমুদ চান্দেলা রাজ্য আক্রমণ করেন ১০১৯ সালে। চন্দেলা রাজ পাতলা গলি দিয়ে পালিয়ে যান 😄।প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে তিনি গজনী ফিরে যান।
***১৪:- মাহমুদ ১০২১-১০২২ সালে গোয়ালিয়র আক্রমণ করেন এবং গোয়ালিয়োর রাজ বার্ষিক কর প্রদান করার প্রতিশ্রতি দিয়ে আত্মরক্ষা করেন।আমি যদ্দুর জানি কনৌজের রাজার জন্য প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল এই অভিযানের উদেশ্য।
***১৫:- কলিঞ্জরের বিরুদ্ধে মাহমুদ ১০২৩ সালে অভিযান পরিচালনা করেন এবং প্রখ্যাত গন্ডার দুর্গ অবরোধ করেন।কলিঞ্জর রাজ ও নিরুপায় হয়ে গোয়ালিয়র রাজার মত করদানের চুক্তি করে আত্মরক্ষা করেন।কলিঞ্জরও প্রতিশোধের জন্যই মাহমুদের আক্রমণের শিকার হয়।
***১৬:- এইবার এই লিস্টের সব থেকে contrivarsal অংশে আসলাম। চালুক্য রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কথিয়াবাড়ের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সোমনাথ মন্দির আক্রমণ ছিল সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমনের সবচে উল্লেখ্যোযোগ্য ঘটনা।ঐতিহাসিক ইবনুল আসির,ইবনে খালদুন, ফিরিস্তা,আধুনিক ঐতিহাসিক ও গবেষক ডব্লিউ. হেগ প্রমুখের মতে সোমনাথ মন্দিরকে হিন্দু পুরোহিতরা ভাবত ইনভিনসিবল।সোমনাথের দেবতা অজেয় এবং ওনার মন্দির ধ্বংস করা কারো সাধ্য নেই।তারা সুলতানকে প্রচুর অভিশাপ দেয় আর চ্যালেঞ্জ করে সোমনাথ আক্রমণ করতে।সোমনাথ মন্দিরের দেবতা মাহমুদকে ভষ্ম করে দেবেন।মাহমুদ সোমনাথ আক্রমণ করতে আসলে নির্ঘাত মরবেন এবং নির্বংশ হবেন blah blah।এইসব কথা শুনলে কার না রাগ হবে?তার ওপর হিন্দু রাজারা প্রচুর সম্পদ মন্দিরে রেখেছিল সুলতান মাহমুদকে চ্যালেঞ্জ করে।১০২৬ সালের ৬ই জানুয়ারি সোমনাথ মন্দিরের দরজায় সুলতান তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন।গুজরাটের রাজা ভীমদেবের নেতৃত্বে হিন্দুরা প্রবল বাঁধা দেয়।কিন্তু তাদের পরাজিত করে সুলতান মাহমুদের বাহিনী।অতঃপর সুলতানের আদেশে মন্দিরের ৩০০ দেবদেবীর মূর্তি বিচূর্ণ করা হয়। এ মন্দির হতে সুলতান মাহমুদ ২ কোটি স্বর্ণমুদ্রা 😲এবং প্রচুর অলংকার হস্তগত করেন!! ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন,”সোমনাথ বিজয় মাহমুদের ললাটে নতুন বিজয় গৌরব সংযুক্ত করে”।এই অভিযান নিঃসন্দেহে মন্দির এবং মন্দিরস্থ দেব দেবীদের বিগ্রহ ধ্বংস করতেই পরিচালনা করা হয়েছিল।
***১৭:- সুলতান মাহমুদের শেষ অভিযান ছিল জাঠদের বিরুদ্ধে।সোমনাথ থেকে ফেরার পথে মুসলিম সৈনিকরা জাঠ দস্যুদের দ্বারা উৎপীড়িত হয়।এইজন্য,তার শেষ অভিযান জাঠ দের উচিত শিক্ষাদানের মাধ্যমে শেষ হয়।
সারাজীবন সংগ্রাম করে এই মহান নৃপতি মৃত্যুবরণ করেন ১০৩০ সালে গজনীতে।
(ভাবছিলাম ইতিহাসটা একটু মজা করে লিখবো। মানে কাহিনীগুলো যৎকিঞ্চিৎ হাস্যরস যোগ করে।বোরিং সাবজেক্ট বলে তো সবাই অবজ্ঞা করে।তাই এইরূপ পদক্ষেপ কিরূপ হবে তা জানার বড় ইচ্ছা🙂।কমেন্ট করে জানাবেন যদি ইচ্ছা হয় 😉।)
See less
Nibedita Paul
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতের অবস্থা ভূমিকা: প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রাকৃতিক সম্পদ ও এশ্বর্ষে ভরপুর ছিল ভারতবর্ষ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে প্রধানত: তিনটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। এগুলো হল বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম । প্রাক-মুসলিম যুগে ভারতবর্ষের শাসনRead more
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতের অবস্থা
ভূমিকা:
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রাকৃতিক সম্পদ ও এশ্বর্ষে ভরপুর ছিল ভারতবর্ষ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে প্রধানত: তিনটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। এগুলো হল বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং হিন্দু ধর্ম । প্রাক-মুসলিম যুগে ভারতবর্ষের শাসন ব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন প্রধান এবং সকল ক্ষেত্রে তাঁর মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হত । রাজার হাতে ন্যস্ত ছিল আইন প্রণয়ন, ক্ষমতার বন্টন, শাসন পরিচালনা এবং সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগের চুড়ান্ত এখতিয়ার। রাজা হর্ষবর্ধন (মৃত্যু ৬৪৫খ্রি.) এর মৃত্যুর পর ভারতবর্ষ রাজনৈতিক বিশৃংঙ্খলায় পতিত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে । এ বিশৃংঙ্খলা ও নৈরাজ্যময় অবস্থা মুসলিম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল । মুসলিম বিজয়ের সময় উত্তর-পশ্চিম ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ সময় ভারতবর্ষের কেন্দ্রিয় শাসন ও সামাজিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল না। জাতিভেদ প্রথা হিন্দুসমাজের এঁক্য ও সংহতির মূলে প্রবল আঘাত হানে ।
ধর্মীয় ও প্রশাসনিক অবস্থা
মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে হিন্দুধর্ম দেশের প্রধান ধর্ম হিসেবে পরিণত হয়। অধিকাংশ রাজাই ছিলেন হিন্দু এবং তারা সকলেই হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের অপ্রতিহত প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিদ্যমান ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে ও শাসনকার্ধে তাদের অধিকার ছিল একচেটিয়া। বৈশ্য ও শুদ্রগণ ছিল নির্যাতিত, নিম্পেষিত এবং নিম্ন শ্রেণির হিন্দুরা ছিল অস্পৃশ্য । ব্রাহ্মণগণ ধর্মীয় ব্যাপারে সর্বেসর্বা ছিলেন। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষে ধর্মীয় অসন্তোষ, অরাজকতা ও নৈরাজ্য চরম আকার ধারণ করে । সাম্প্রাদায়িক কলহ ও ধর্মীয় কোন্দল মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। প্রাক-মুসলিম যুগে বংশানুক্রমিকভাবে ভারতবর্ষের রাজা নিযুক্ত হতেন। রাজকুমারীগণও শাসনকার্ষে অংশগ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। রাজার হাতেই ছিল সমস্ত ক্ষমতা । তিনি আইন প্রণয়ন ও শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ন্যায় বিচারের উৎস এবং প্রধান সেনাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত পালন করতেন । তিনি রাজধর্মের আলোকে শাসনকার্ পরিচালনা করতেন । রাজকার্য পরিচালনার ব্যাপারে মন্ত্রীগণ রাজাকে পরামর্শ দিতেন এবং সাহায্য করতেন। তবে রাজা তাঁদের পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য ছিলেন না। এ সময় সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রাদেশিক প্রধানকে বলা হত “উপারিক’ । তাঁর প্রধান কর্তব্য ছিল প্রদেশের শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা করা রাজার আদেশকে কার্যকরী করা এবং প্রয়োজনে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা। প্রদেশগুলি জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাকে বলা হত “বিষয়’। জেলার শাসনকর্তা বিষয়পতি নামে অভিহিত হতেন । দেশের শাসন ব্যবস্থার সর্বনিমনস্তরে ছিল গ্রাম । গ্রামের শাসন ব্যবস্থা মোড়ল বা পঞ্চায়েত কর্তৃক সম্পাদিত হত।
অর্থনৈতিক অবস্থা
মুসলিম বিজয়ের প্রান্কালে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ও ধর্বর্ষে পরিপূর্ণ ছিল ভারতবর্ষ। এ দেশের মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ । অভিজাত ও উঁচু শ্রেণির অধিকাংশ লোক বিলাসবহুল জীবন যাপন করত। প্রাচীন অর্থশান্ত্রবিদ কৌটিল্যের বিবরণ অনুযায়ী তিনটি মৃখ্য উৎস থেকে রাষ্ট্রের আয় ছিল: ক) ভূমি রাজস্ব, খ) সামন্ত প্রভূ ও জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর, এবং গ) আবগারী ও বাণিজ্য শুন্ক। পরবর্তীতে এদেশে শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে । গুজরাট ও বাংলা কাপার্স বন্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বিখ্যাত ছিল। ব্যবসায়-বাণিজ্যেও উৎকর্ষ সাধিত হয়। বিভিন্ন পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হতে থাকে। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো ছিল বলে এদেশে সংস্কৃতি ও সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটেছিল । চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বর্ণনা থেকে পঞ্চম শতাব্দির শুরুতে ভারতবর্ষের উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, মগধের লোকেরা ধনী ও সমৃদ্ধশালী ছিল। পর্যটক হিউয়েন সাঙ-এর বর্ণনায় জানা যায় যে, সপ্তম শতাব্দিতেও ভারতবর্ষের অধিবাসীগণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করত ও নির্বিয়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করত। এদেশের অতুল এশ্বর্ষে আকৃষ্ট হয়ে বিদেশী বণিকগণ যেমন এদেশে বারবার এসেছেন আবার বিদেশী আক্রমণকারীগণও এ দেশ বার বার লুগ্ঠন করে তাদের কর্তৃত প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াস চালিয়েছেন ।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
তৎকালীন হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র-এই চারটি বর্ণ স্তরে বিভক্ত ছিল। সমাজে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের অপরিসীম প্রভাব বিস্তৃত ছিল। আর বৈশ্য ও শুদ্রদের অবস্থান ছিল সমাজের নিমস্তরে । শুদ্রদের সমাজে অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হত। জাতিভেদ প্রথা খুব কঠোর ছিল । জনসাধারণ স্ব স্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ করতে পছন্দ করত । ব্রাহ্মণরা শিক্ষা, ধর্মকর্ম, আচার অনুষ্ঠান ছাড়াও কখনো কখনো যুদ্ধ বিগ্রহে নিয়োজিত থাকতো । ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ধ বিরহ, বৈশ্যরা ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং শুদ্রগণ কৃষিকাজ ও সাধারণ কাজ কর্ম করত। বর্ণপ্রথার কারণে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্ভ্বীতির অভাব ছিল । সমাজে বহু বিবাহ, সতীদাহ ও সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিল । কিন্তু বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল না। নারীরা অন্ত:পুরে জীবন যাপন করতেন। তাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্য ছিল না। দাসপ্রথা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়। এতদ্বস্েও অভিজাত শ্রেণির মেয়েরা উদার শিক্ষা লাভ করত। তারা শাসন ক্ষেত্রে ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করত । মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে প্রভূত অগ্গতি লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলা চর্চায় ভারতীয়গণ কৃতিতৃ অর্জন করেন। সে যুগে ভারতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে । ভারতের স্বনামধন্য বল্পভী এবং বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উদন্তপুর, বিক্রমশীলা, বারানসী প্রভৃতি স্থানে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছিল। মালব ও আজমীরে সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয়েছিল । জ্যোর্তিবিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন ও সাহিত্য প্রভৃতি জ্ঞানের চর্চা করা হত। সে যুগে স্থাপত্য ও ভাক্কর্য শিল্পে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছিল ।
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা:
আফগানিস্তান, কাশ্মীর ও কনৌজ: মৌর্য বংশের শাসনামল থেকেই আফগানিস্তান ছিল ভারতের একটি অংশ । মুসলিম এঁতিহাসিকগণ এটিকে হিন্দুশাহী রাজ্য বলে অভিহিত করেন। সপ্তম শতাব্দিতে কর্কট রাজবংশীয় দুর্লভ বর্ধনের অধীনে কাশ্মীর ছিল উত্তর ভারতের অপর একটি স্বাধীন রাজ্য। বিজেতা, বিদ্যোৎসাহী ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় ছিলেন কাশ্মীরের রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর । তিনি কনৌজ, কামরূপ, কলিঙ্গ ও গুজরাট জয় করেন বলে জানা যায়। কর্কট বংশের অপর একজন শাসক জয়গীড় গৌড় ও কনৌজের নৃপতিদের পরাজিত করেন। অষ্টম শতাব্দির প্রথম দিকে কনৌজ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হত। উত্তর-ভারতের অন্যতম পরাক্রমশালী রাজা যশোবর্মণ কনৌজের হত গৌরব ও আধিপত্য পুনরুদ্ধার করেন। তিনি গৌড় জয় করে এর রাজাকে হত্যা করেন এবং কাশ্মীর রাজ ললিতাদিত্যের সহায়তায় তিব্বত অভিযান করেন। তিনি চীনে দূত প্রেরণ করেন। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক তিনি পরাজিত ও নিহত হন। রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
সিন্ধু ও মালব-দিল্লি ও আজমীর
সপ্তম শতকে সিন্ধু ছিল হ্র্ষবর্ধনের সাগ্রাজ্যভূক্ত। পরবর্তীতে “চাচ” নামক সিদ্ধুর জনৈক ব্রাহ্মণ মন্ত্রী সিন্ধুতে স্বাধীন রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন । চাচের পুত্র রাজা দাহিরকে পরাজিত করে ইমাদউদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাশিম ৭১২ সালে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এ রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রতিহার রাজপুতদের দ্বারা শাসিত মালব ছিল উত্তর- ভারতের একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র । উজ্জয়িনী ছিল এ রাজ্যের রাজধানী । দ্বাদশ শতকে মুসলিম অভিযানের প্রান্কালে দিল্লি ও আজমীরে শক্তিশালী চৌহান বংশীয় রাজপুব্রগণ রাজত্র করত । এ বংশের শাসক বিশালদেব চৌহান প্রতিহর বংশের নিকট থেকে দিল্লি দখল করেন। রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে তারা একটি বিশাল রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
গুজরাট, আসাম ও নেপাল
প্রতীহার বংশের অধীনে অত:পর তাদের আধিপত্য ক্ষুন্ন করে চালক্য ও ভাগেলা বংশ পর্যায়ক্রমে গুজরাট শাসন করে। নবম শতাব্দিতে চান্দেলা বংশ বুন্দেলখন্ডে এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। শেষ রাজা গন্ড ১০১৯ হন। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পূর্ব প্ান্তসীমায় অবস্থিত একটি রাজ্য হল আসাম । এটি হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়। এ সময় রাজা শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার স্বাধীন নৃপতি। হ্র্ষবর্ধনের সমসাময়িক এই শাসকের মৃত্যুর পর বাংলায় মারাত্মক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নেপাল সপ্তম শতাব্দিতে উত্তর ভারতের অপর একটি স্বাধীন রাজ্য। নেপালের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
See less