বাবু – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় | Bengali essay Babu Written by Bankim Chandra pdf
Lost your password? Please enter your email address. You will receive a link and will create a new password via email.
Please briefly explain why you feel this question should be reported.
Please briefly explain why you feel this answer should be reported.
Please briefly explain why you feel this user should be reported.
বাবু – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(‘লোকরহস্য’ বইয়ের অন্তর্গত একটি প্ৰবন্ধ। মূলত এটি প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৭৯-র ফাল্গুন সংখ্যায়।)
“জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলি যুগে নেতা নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন । তাঁহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য করিবেন, তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে । আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন ।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরবর! আমি সেই কূটবুদ্ধি, পানভোজনকুশলী নেতাগণকে আখ্যাত করিব, আপনি শ্রবণ করুন । আমি সেই চেন অলংকৃত, অদ্ভুতচরিত্র, বহুভাষী, বাইট-প্রিয় নেতাদিগের চরিত্র কীর্তিত করিতেছি, আপনি শ্রবণ করুন । হে রাজন, যাঁহারা পাঞ্জাবি-পাজামাবৃত, মোবাইলকর্ণগত, গ্রহরত্নখচিত অঙ্গুরিয়শোভিত, এবং রোদচসমা পরিহিত, তাঁহারাই নেতা । যাঁহারা বাক্যে অজেয়, অপভাষাপারদর্শী, সুস্থভাষাবিরোধী, তাঁহারাই নেতা । মহারাজ! এমন অনেক মহাবুদ্ধিসম্পন্ন নেতা জন্মিবেন যে তাঁহারা সুস্থভাষায় বাক্যালাপে অসমর্থিত হইবেন । যাঁহাদিগের রসনেন্দ্রিয় অন্যদলীয় নেতানেত্রীপ্রতি গালিদানে পবিত্র, তাঁহারাই নেতা । যাঁহাদিগের চরণ মাংসাস্থিবিহীন শুষ্ক কাষ্ঠের ন্যায় হইলেও দুর্বলোপরি পাদপ্রহারে সক্ষম; হস্ত দুর্বল হইলেও মাইকধারণে এবং অর্থগ্রহনে সুপটু, তাঁহারাই নেতা । যাঁহারা ক্ষমতালাভের উদ্দেশ্যে রাজনীতি করিবেন, রাজনীতির জন্য পার্টি করিবেন, পার্টির জন্য অপরাধ করিবেন, এবং আইনের হস্ত হইতে বাঁচিবার জন্য অপর পার্টিতে যোগদান করিবেন, তাঁহারাই নেতা ।
মহারাজ! নেতা শব্দ নানার্থ হইবে । যাঁহারা কলিযুগের ভারতবর্ষে পরোক্ষে শাসক হইয়া ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নামে খ্যাত হইবেন, তাঁহাদিগের নিকট ‘নেতা’ অর্থে শ্রমিক ইউনিয়নের পদাধিকারী বুঝাইবে । আই-পি-এল দলবিশেষের খেলোয়াড়দিগের নিকটে ‘নেতা’ শব্দে চিত্রতারকা বুঝাইবে । মার্কেটিং কর্মীদের নিকট ‘নেতা’ অর্থে টিম লিডার বুঝাইবে । এ সকল হইতে পৃথক, কেবল নেতাজন্ম নির্বাহ করিতে অভিলাষী কতকগুলিন মনুষ্য জন্মিবেন। আমি কেবল তাঁহাদিগেরই গুণকীর্তন করিতেছি । যিনি বিপরীতার্থ করিবেন, তাঁহার এই মহাভারত শ্রবণ নিষ্ফল হইবে। তিনি জনগণের এক জন হইয়া নেতাদিগের লক্ষ্য হইবেন ।
হে নরাধিপ! সাধারণের বিপরীতে অবস্থান করিবার নিমিত্ত পঞ্চভূত নেতাদিগেরই কর্তৃত্বাধীন থাকিবেন । যথা, ক্ষিতি ইঁহাদিগের অতীব ক্ষমতাশালী আয়ুধ হইবে । শতনামে সহস্র পরিমাণ জমি নেতাগণ ভোগ করিবেন । দ্বিতীয় অগস্ত্যের ন্যায় সমুদ্ররূপী বরুণকে ইঁহারা শোষণ করিবেন, পানপাত্র ইঁহাদিগের গন্ডূষ । অগ্নিও ইঁহাদিগের আজ্ঞাবহ হইবেন – ‘সিগারেট’ নামক একটি অভিনব খান্ডবকে আশ্রয় করিয়া রাত্রিদিন ইঁহাদিগের মুখে লাগিয়া থাকিবেন । ইঁহাদিগের যেমন মুখে অগ্নি, তেমনি অন্তরেও অগ্নি জ্বলিবেন । সেই অন্তরাগ্নির জ্বলন মধ্যে মধ্যে অন্যদলীয় সমর্থকরা তাঁহাদের আপন গৃহাভ্যন্তরে অনুভব করিবেন । বায়ু ইঁহাদিগের গৃহের বাহিরে বাহনরূপে এবং জঠরমধ্যে গ্যাসরূপে নিত্য বিরাজমান থাকিবেন । ইঁহাদিগের অধিকাংশ চন্দ্রলোভী বামন হইবেন, কেহ কেহ মধ্যাহ্নে চন্দ্র এবং নিশীথে সূর্য দেখিবেন ।
সমাজকে ইঁহারা বহুধা বিভক্ত করিবেন—ভদ্রতা করিয়া সেই দুর্ধর্ষ কার্যের নাম রাখিবেন, ‘সমাজসেবা’। জনগণের সম্মুখে ইঁহারা পূজার্চনা করিবেন, মন্দির মসজিদ গড়িবেন, আর তাঁহাদিগের পশ্চাতে যে পবিত্র স্থানে ইঁহারা আরাধনায় নিমগ্ন থাকিবেন তাহার নাম হইবে ‘গেস্ট হাউস’।
হে নরশ্রেষ্ঠ! যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধ কোকিলাহারী, যাঁহার পান্ডিত্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুস্তকাগত, তিনিই নেতা। ইঁহাদিগের সমর্থকেরা ইঁহাদের কাব্যে কালিদাস, সঙ্গীতে সরস্বতী, পান্ডিত্যে পাণিনি বলিয়া প্রচার করিবেন এবং তাহা শ্রবণ করিয়া যিনি আপনাকে অনন্তজ্ঞানী বিবেচনা করিবেন, তিনিই নেতা । যিনি নারীজাতির অবমাননাকারির শাস্তি লঘু করিতে প্রতিশ্রুত হইবেন, পরে তাঁহার বক্তব্য বিকৃত করা হইয়াছে দাবি করিয়া সংবাদ মাধ্যমের মুন্ড চর্বন করিবেন, তিনিই নেতা । যিনি স্বদলীয় কর্মীর অপরাধ লুকাইয়া রাখিবেন, ব্যক্তিবিশেষকে ব্যবহার করিয়া অবৈধ সুবিধা লইবেন এবং সুবিধালাভ সমাপ্ত হইলে তাহাকে সুদূরে নিক্ষেপ করিবেন, তিনিই নেতা । যাঁহার বাক্য মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং ভাষণকালে সহস্র, তিনিই নেতা ।
যিনি ইতিহাসের কিছুই জানিবেন না, অর্থনীতির কিছুই বুঝিবেন না, কেবল আপনাকে অভ্রান্ত জানিয়া আপনার মত জনগণের উপর চাপাইয়া দিবেন, তিনিই নেতা । যিনি ফান্ড সংগ্রহার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, সমর্থকদের প্রীতিসম্পাদনার্থ গণেশপূজা করিবেন এবং নির্বাচনে জয়ের লোভে ঈদ পালন করিবেন, তিনিই নেতা ।
হে কুরুকুলভূষণ! দেবদেবীদের কথা যখন উঠিল তখন বলা যাউক, বিষ্ণুর সহিত এই নেতাদিগের বিশেষ সাদৃশ্য হইবে । ইঁহারা বিষ্ণুর তুল্য লীলাপটু হইবেন, বিষ্ণুর ন্যায় ইঁহাদিগেরও দশ অবতার হইবে । যথা – কেরানী, মাস্টার, অভিনেতা, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, ধর্মগুরু, অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, সংবাদপত্র সম্পাদক এবং নিষ্কর্মা। সকল অবতারেই ইঁহারা অমিত বলপরাক্রম অসুরগণকে বধ করিবেন । কেরানী অবতারে বধ্য অসুর প্রশাসন মুখাপেক্ষী, মাস্টার অবতারে বধ্য ছাত্র, অভিনেতা অবতারে বধ্য দর্শক, ব্যবসায়ী অবতারে বধ্য ক্রেতা, ডাক্তার অবতারে বধ্য রোগী, উকিল অবতারে বধ্য মক্কেল, ধর্মগুরু অবতারে বধ্য ধর্মভীরু, অফিসার অবতারে বধ্য আপনারই ছেড়ে আসা সরকার, সম্পাদক অবতারে বধ্য পাঠক, এবং নিষ্কর্মাবতারে বধ্য উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী ।
হে নরনাথ! আমি যাঁহাদিগের কথা বলিলাম, তাঁহাদিগের মনে মনে বিশ্বাস জন্মিবে যে, তাঁহারা আইনসভা দখল করিয়া, তথায় বাগাড়ম্বরের মেঘ জমাইয়া, মরিচবিষের বৃষ্টি নামাইয়া, কর্দমাক্ত সলিলে মৎস্যশিকার করিয়া ভারতবর্ষের পুনরুদ্ধার করিবেন ।
জনমেজয় কহিলেন, হে মুনিপুঙ্গব! নেতাদিগের জয় হউক, আপনি অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করুন ।”