একটি বট গাছের আত্মকথা (বিঃদ্রঃ - এখানে পরপর দুই রকম রচনা দেয়া হলো। আপনার যেটা ভালো লাগে পড়ে নিতে পারেন ) ভূমিকা: আমাকে চিনতে পারছো? প্রতিদিন রাস্তা পার করার সময়, হয়তাে ব্যস্ততায় বা গাড়ির দাপটে কিংবা অন্যমনস্কভাবে আমার তলায় দাঁড়িয়েছ! কিন্তু কখনও খুঁটিয়ে আমায় লক্ষ করেছ কি? আমি তো অনেক ইতিহাসেRead more
একটি বট গাছের আত্মকথা
(বিঃদ্রঃ – এখানে পরপর দুই রকম রচনা দেয়া হলো। আপনার যেটা ভালো লাগে পড়ে নিতে পারেন )
ভূমিকা: আমাকে চিনতে পারছো? প্রতিদিন রাস্তা পার করার সময়, হয়তাে ব্যস্ততায় বা গাড়ির দাপটে কিংবা অন্যমনস্কভাবে আমার তলায় দাঁড়িয়েছ! কিন্তু কখনও খুঁটিয়ে আমায় লক্ষ করেছ কি? আমি তো অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কত যুগ পরিবর্তনের নীরব দর্শক আমি!কোনাে দিন জানতে চেয়েছ কি কত শত বিস্তৃত কাহিনি আমার রক্তে ধারণ করে, আমি মুখ বুজে দাঁড়িয়ে রয়েছি। তােমাদের জীবনের মতাে সংঘাতময় উত্থান-পতন হয়তাে আমার জীবনে নেই। তবে আমার সহ্যশক্তি আর অভিজ্ঞতায় আমি হয়েছি শান্ত, স্থির ও প্রাজ্ঞ ।
আমি এক বটগাছ। আজও ঝাপসা মনে পড়ে সেই কবেকার ছােটোবেলাকার কথা। মায়ের বৃন্ত থেকে বােধহয় একটি টিয়াপাখি আমাকে ফেলে দিয়েছিল রাস্তার ধারে বােসপুকুরের এই প্রান্তে। তার কয়েকদিন পরে চোখ মেলে দেখেছিলাম এই সুন্দর পৃথিবীকে। চাপা রঙের রােদুরের বুকে আকাশের গায়ের টুকরাে টুকরাে মেঘ হাত নেড়ে আমায় বেড়ে উঠতে বলেছিল। মাটির কাছ থেকে সাহস পেয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছিলাম। তারপর আমার পল্লবিত ছােটো ছােটো শাখারা সূর্যের সামনে দৃপ্তভাবে নিজেকে মেলে ধরতে শিখল।
ক্রমে আমি বড়াে হলাম। আমার ছায়ায় শ্রান্ত মানুষ খুঁজে পেল কত আশ্রয়। কত পথিক, নাম-না-জানা বুড়াে-বুড়ি আমার কাছে এসে বিশ্রাম নেয়। বেশ ভালাে লাগে। ডালপালা বাড়িয়ে রােদ কিংবা বৃষ্টির হাত থেকে ওদের প্রাণপণে বাঁচাতে চেষ্টা করি। জানাে তাে আমাদের এক জাতিকে নিয়ে তােমাদের রবি ঠাকুর লিখেছিলেন-“নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ মাথায় লয়ে জট/ছােট ছেলেকে মনে কি পড়ে, ওগাে প্রাচীন বট।
প্রতিদিনের জীবনযাত্রা : আমার বিশাল ছাতার মতাে নিরাপদ না আশ্রয়ে কাকের দল বাসা বানিয়েছে। কাঠবেড়ালি দুবেলা ছুটোছুটি করে আমার ডালে খুঁজে বের করেছে স্বাচ্ছন্দ্যের কোটর। দূর আকাশ থেকে প্রচণ্ড গরমে পরিশ্রান্ত চিল নেমে এসে আমার ডালে বসে। মাঝেমধ্যেই কোকিল এসে গান শুনিয়ে যায়, আর দেখি কাকের বাসা খুঁজতে গিয়ে আমার পাতার মাঝে নিজেকে কেমন লুকিয়ে রাখে। এ ছাড়া যাওয়া-আসার পথে কত পাখি যে আমার গায়ে বসে একটু জিরিয়ে নেয় তার ইয়ত্তা রা নেই।
যেই বর্ষা নামে, আমি পাতাগুলাে মেলে ধরে শ্রাবণ অরণ্যের ঘ্রাণ পেতে চেষ্টা করি। যদিও আমার ফল মানুষ খায় না, কিন্তু পূজাপার্বণে আমার পাতা সংগ্রহ করতে আসে। প্রথম প্রথম পাতা ছিড়লে ব্যথা লাগত, রাগও হত খুবই কিন্তু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মনে মনে ভাবি মানুষের কাজে তাে লাগি। এখন গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে আমার চারপাশে একটা বেদি করে দিয়েছে। সেখানে বর্ষায় মানুষ এসে বসে, গরমে গােল হয়ে বসে মৃদু বাতাসের আনন্দ নেয়।
উপসংহার: আজ আমি বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। কালবৈশাখী ঝড় দেখলে মনে কেমন আশঙ্কা জাগে। বাজের শব্দে চমকে উঠি। ভয় হয় রাস্তা তৈরির প্রয়ােজনে মানুষেরা আমায় কেটে টুকরাে টুকরাে করে ফেলবে না তাে! হয়তাে এরকম কোনাে কারণেই আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমায় চলে যেতে হবে। তবু যে কটা দিন আছি,আলাে-অন্ধকার ও আনন্দ-বেদনার দোলনায় দোলানাে এ ধরিত্রীকে বড়াে সুন্দর বলে মনে হয়েছে। সহস্র মানুষ-পশু-পাখিকে হাওয়ায় ছায়ায় আগলে ও পৃথিবীকে প্রাণের মায়ায় আঁকড়ে, সার্থক আমার এ জীবন
See less
একটি নদীর আত্মকথা আমি তোমাদের চির চেনা একটি নদী-আমার নাম 'গঙ্গা'। গঙ্গা নামটি আমার কাছে অনেক প্রিয়। আমাকে জটায় লুকিয়ে রেখে শিব 'গঙ্গাধর' নাম পেয়েছেন। আমার পক্ষে এটা কম গৌরবের কথা নয়। তবে দুঃখ হয়— ত্রিলোকেশ্বরের মাথায় উঠে কত না চঞ্চলতা করেছি—কত না পাপ হয়েছে তাতে। আমার অপর একটা নাম জাহ্নবী। তবেRead more
একটি নদীর আত্মকথা
আমি তোমাদের চির চেনা একটি নদী-আমার নাম ‘গঙ্গা’। গঙ্গা নামটি আমার কাছে অনেক প্রিয়। আমাকে জটায় লুকিয়ে রেখে শিব ‘গঙ্গাধর’ নাম পেয়েছেন। আমার পক্ষে এটা কম গৌরবের কথা নয়। তবে দুঃখ হয়— ত্রিলোকেশ্বরের মাথায় উঠে কত না চঞ্চলতা করেছি—কত না পাপ হয়েছে তাতে। আমার অপর একটা নাম জাহ্নবী। তবে এই নামটা আমার তেমন পছন্দের নয়। একটু ছেলেমানুষী করেছিলাম বলে রাক্ষুসে মুনি আমায় গিলে ফেলেছিল।
ঠিক কোন্ কালে জ্ঞানের উন্মেষ হয় তা যেমন তোমাদের কাছে অজানা তেমনি আমারও জানা নেই। এখন ঠিক করে বলা অসম্ভব কবে, কেমন করে আমি বড় হয়ে তােমাদের মাঝখানে এসে পড়েছি, আর কি ক’রেই বা তােমাদের কাছে এত পরিচিত হ’য়েছি। তবে শৈশবের স্মৃতি মনের কোণে মাঝে মাঝে অম্পষ্ট হ’য়ে ফুটে ওঠে। মনে হয় কত যুগ আগে আমি যেন কোন তুষারের রাজ্যে একা একা আপন মনে ঘুরে বেড়াতাম ; শীতের দিনে কুঁকড়ে কুঁকুড়ে চলাফেরা করতাম, কখনও বা একটু আধটু খেলা করবার লােভ হতো। যখন একটু গরম পড়তাে তখন একটু একটু করে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতাম সামনে কি আছে দেখবো বলে; বাহির বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার মনে জেগে ওঠে। কিন্তু বড় বড় পাহাড়গুলাে পথ রােধ করে দাড়িয়ে ধমক দিয়ে বলতাে-অতটুকু মেয়ে যাচ্ছ কোথা? ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াতাম, কিন্তু বহির্জগতের বিরাট জীবনধারার বিচিত্র কোলাহল আমাকে অবিরত আহ্বান করতাে। তাই পাহাড়গুলাের পাশ কাটিয়ে চুপি চুপি এগিয়ে যাবারই চেষ্টা করতাম।
অবশেষে সব বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সফলতার দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একদিন বুঝলাম আমার শক্তি সহস্রগুণ বেড়ে গেছে। শুধু এইটাই বুঝতে পারি না কতদিন আমি সেই তুষারের দেশে কাটিয়েছি আর ঠিক কোন দিনটিতে কেমন করে আমি শক্তির প্রাচুর্য্যে ছুটুতে স্থরু করেছি তােমাদের দিকে। তােমরা বল ভগিরথ তপস্যা করে আমায় নিয়ে এসেছেন কিন্তু আমার তাে মনে হয় আমারই তপস্যায় তুষ্ট হ’য়ে কোন মহাপুরুষ হঠাৎ একদিন আমাকে পাষাণকারা চুর্ণ করে উদ্দামবেগে ছুটে চলবার শক্তি দিয়েছিলেন। যাই হােক তখনকার সে উত্তেজনা জীবনে কোন দিন ভুলবো না। কত বাধা এল, কিন্তু কেউ সেদিন আমার সামনে দাড়াতে পারলাে না। বড় বড় পাহাড়গুলােকে ধাক্কা মেরে তাদের মাথায় পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চললাম, আমার মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে লাগলাে, চুলগুলাে পিছন দিকে উড়তে লাগলাে। তবু আমার শ্রান্তি এল না, এতটুকু বিচলিত হলাম না। ছােট ছােট গাছ আর লতাগুলাের কি স্পর্ধা! তারা চাইল আমার পথ রােধ করতে। বেচারীদের দুর্ভাগ্যের কথা আর কি বলব।দেশ ছাড়া হয়ে পাক খেতে খেতে আমার সঙ্গে তারা ছুটতে থাকলা। যা পায় সামনে তাই ধ’রে বাঁচতে চায় কিন্তু তাদের কোথাও দাড়াতে না দিয়ে টেনে নিয়ে ছুটলাম।
যেদিন তােমাদের মাঝখানে এসে দাড়ালাম, সেইদিন কেন জানি না, আমি কেমন একরকম হয়ে গেলাম। মনে এই প্রশ্নের উদয় হলে জীবন কি? কিসের জন্য আমার জন্ম? কিসের জন্য সংসারে আমার অস্তিত্ব? স্তির হয়ে ভাবলাম-ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গেছি এমন সময় শুনতে পেলাম নিখিল বিশ্ব যেন সঙ্গীতের ঝংকারে বলে উঠলা – বেঁচে থাকা পরের জন্য, জীবের সেবা জন্যই অস্তিত্ব; পরোপকারে যে জীবন উৎসর্গ করতে পারে, জীবনান্তে বিশ্বপতির ক্রোড়ে সেই স্থান পায়। সেদিন থেকেই আমার পরিবর্তন হয়েছে, আমার ভীষণতা দূর হয়েছে। সেদিন থেকেই আমি ছু’হাতে তােমাদের অন্য বিতরণের চেষ্টা করে এসেছি। জানি না—অসীমের বুকে আমার স্থান হবে কিনা।
See less